পদ্মা বিধৌত জেলা রাজবাড়ী। এ জেলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা, গড়াই ও হড়াই নদী। প্রতি বছরই পদ্মা ও গড়াই নদীর ভাঙনে ছোট হচ্ছে রাজবাড়ীর মানচিত্র। ভিটেমাটি ও ফসলি জমি হারাচ্ছেন নদী পারের মানুষেরা।

প্রতি বছরের ন্যায় চলতি বছরেও বর্ষায় মৌসুমের শেষে শুরু হয়েছে পদ্মার ভাঙন। এই নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছে শত বিঘা ফসলি জমি। ভিটেমাটি হারাচ্ছেন মানুষ। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গ্রামীণ সড়ক, ব্রিজ, বসতবাড়িসহ বহু স্থাপনা। 

স্থানীয়দের অভিযোগ, পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তলনের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। এতে নদীতে ভাঙন তীব্র হচ্ছে। এছাড়া নদীর তীর স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ না করার ফলে নদীতে ভাঙন অব্যহত রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে ভাঙন ঠেকাতে শুষ্ক মৌসুমে নদীর সংরক্ষণের কোনো পদক্ষেপ নেয় না পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টরা। ফলে প্রতি বছরই পদ্মার ভাঙনে বিলীন হচ্ছে শত শত বিঘা ফসলি জমি।

চলতি বছর গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় ভাঙন শুরু হয়ে। দুই সপ্তাহের ভাঙনে প্রায় ১০০ বিঘা ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হলেও তারা ভাঙন রোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) রাজবাড়ী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজবাড়ী জেলার সদর উপজেলা, গোয়ালন্দ, কালুখালী ও পাংশা এ চার উপজেলা ঘেষে রয়েছ পদ্মা নদী। যার দৈর্ঘ্য ৫৬ দশমিক ৬ কিলোমিটার। আর বালিয়াকান্দি উপজেলা, পাংশা উপজেলা ও কালুখালী উপজেলার অন্য পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ৩৮ কিলোমিটার গড়াই নদী। ফলে নদীভাঙন এ জেলার মানুষের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সর্বশেষ ২০১৭-২২ সাল পর্যন্ত রাজবাড়ী শহর রক্ষাবাঁধের ডান তীর রক্ষায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার এলাকায় ৩৭৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ব্লক ফেলে স্থায়ী কাজ করা হয়। বর্তমানে জেলায় নদী শাসনে কোনো প্রকল্প চলমান নেই। রাজস্ব বাজেটে সীমিত পরিসরে রাজবাড়ী সদর উপজেলার চর সিলিমপুর ও সোনাকান্দর এলাকায় ১ হাজার ৫১২ মিটার জায়গা জুড়ে কাজ চলছে। গত বছরের বর্ষা মৌসুমে ভাঙন রোধে ৬১টি প্যাকেজে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলার মধ্যে ১০টি ইউনিয়ন নদী তীরবর্তী হওয়ায় ওই ১০টি ইউনিয়নে প্রতি বছরই ভাঙন দেখা দেয়। এই দশটি ইউনিয়ন হচ্ছে পাংশা উপজেলার বাহাদুরপুর, হাবাসপুর, কালুখালী উপজেলার কালিকাপুর, রতনদিয়া, রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর, চন্দনী, বরাট, গোয়ালন্দ উপজেলার ছোট ভাকলা, দেবগ্রাম, দৌলতদিয়া। প্রতি বছরই এই দশটি ইউনিয়নে কম বেশি ভাঙন দেখা যায়।

সরেজমিনে গত সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের চর নারায়ণপুর, চর বেনীনগর, চর সিলিমপুর, মহাদেবপুর ও কালীতলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায় প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পদ্মার ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। ভাঙনে শত শত বিঘা ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। কৃষকরা নদীর তীরে বসে তাদের হারানো ফসলি জমির দিকে অপলক দৃষ্টি তাকিয়ে রয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা ভাঙনে প্রায় শতাধিক বিঘা ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। কিন্তু ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি প্রাথমিকভাবে ভাঙন ঠেকাতে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলানো হয়নি। ভিটেমাটি ও ফসলি জমি হারিয়ে পদ্মা পারের মানুষের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়েছে।

মিজানপুর ইউনিয়নের চর বেনীনগর গ্রামের বাসিন্দা তোরাপ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদীতে অবৈধভাবে বালু কেটে গর্ত করার কারণে আমাদের জমিজমা ভেঙে নদীতে চলে যাচ্ছে। আমার ২০ পাখি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। এ বছর আমি কোনো ফসল আবাদ করতে পারিনি। সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া পাওয়া একটাই নদীটা তারা স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করে দিক। তাতে আমাদের জমিজমা ঠেকে থাকলে আমরা বেঁচে যাব।

একই এলাকার বাসিন্দা রহমত আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদীতে জেলা ১০০ বিঘা ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে। নদী ভাঙতে ভাঙতে আমরা এখন পঙ্গু হয়ে গেছি। আমাদের চলার মতো এখন কোনো পরিস্থিতি নেই। এবছরই আমার ৫/৬ পাখি জমি নদীতে চলে গেছে। এরকম ভাবে নিজের আবাদি জমি চোখের সামনে নদীতে চলে গেলে আমরা কিভাবে বাঁচব। এখন সরকারের কাছে আমাদের দাবি তারা সঠিক বন্দোবস্ত করে নদী রক্ষা করুক। নদী বাঁচলে আমরাও বেঁচে থাকতে পারব।

পদ্মা পারের বাসিন্দা হান্নান মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, অবৈধভাবে নদীতে বালু কাটার কারণে মাটি নিচ থেকে ঢিল হয়ে যায়।ফলে মাটি নিচ থেকে আলগা হয়ে গেলে স্রোত এসে মাটি কেটে নিয়ে যায়। এই চর টুকুই আমাদের শেষ সম্বল। এখানে আমরা চাষাবাদ ও গরুছাগল চড়াতাম। এটা ভেঙে গেলে আমরা নিরুপায়।

আরেক গণমাধ্যম কর্মী সুমন বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদী ভাঙন রাজবাড়ী জেলার প্রধান সমস্যা। কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে নদী ভাঙন হলেও এ জেলায় নদী ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড মাত্র ৫০০ কোটি টাকার কাজ করেছে। এই ৫০০ কোটি টাকার কাজ করে পদ্মার মতন খরস্রোতা নদীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। নদী ভাঙন রোধ করতে হলে বড় ধরণের প্রকল্প নিতে হবে। বড় ধরণের অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। পদ্মা তীরবর্তী রাজবাড়ী জেলায় আছে ৮৫ কিলোমিটার অংশ। প্রতিবছর কোথাও না কোথাও ভাঙে। কিন্তু  ৪/৫ কিলোমিটার মেরামত করে নদী ভাঙন রোধ করা যাবে না। এজন্য বড় প্রকল্প নিতে হবে।

এ বিষয়ে রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল্লাহ আল আমিন বলেন, রাজবাড়ী জেলা পদ্মা ও গড়াই নদীর তীরে অবস্থিত। পদ্মা নদীর ৫৬ কিলোমিটার ও গড়াই নদীর ৩৮ কিলোমিটার এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ।পদ্মার ৫৬ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যে ভাঙন রয়েছে সে বিষয়ে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আমরা সরেজমিনে ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

মীর সামসুজ্জামান/আরকে