২৫ দিন ধরে পানির নিচে রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু
পার্বত্য জেলা রাঙামাটির পর্যটন আইকন হিসেবে পরিচিত ঝুলন্ত সেতু প্রায় মাসখানেক ধরে পানির নিচে ডুবে আছে। টানা তিন দিনের ছুটিতে পর্যটকে মুখর থাকার কথা থাকলেও শূন্যতা বিরাজ করছে ঝুলন্ত সেতুতে। গত ৩ সেপ্টেম্বর সেতুতে প্রথম পানি উঠতে শুরু করে। ২৫ দিন পার হয়ে গেলেও এখনো কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ডুবে আছে সিম্বল অব রাঙামাটি খ্যাত ঝুলন্ত সেতুটি। বর্তমানে সেতুর রেলিং পর্যন্ত পানি উঠে প্রায় পুরোটাই ডুবে গেছে।
বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে দেখা যায়, সেতুতে প্রবেশের গেটটি খোলা থাকলেও টিকিট বিক্রি বন্ধ রয়েছে। পর্যটকরা যাতে সেতুতে প্রবেশ করতে না পারেন সেজন্য বাঁশ দিয়ে সেতুতে প্রবেশের পথটি বন্ধ করে দেওয়া হয়ে। পাশাপাশি বিপজ্জনক চিহ্ন হিসেবে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে লাল পতাকা। তবুও কিছু কিছু পর্যটক সেতু সংলগ্ন এলাকায় প্রবেশ করছেন। সেতুর মুখ থেকে ট্যুরিস্ট বোটে করে সেতুর অংশটুকু পার হয়ে সেতুর অপর প্রান্তে যাচ্ছেন পর্যটকরা। কিন্তু সেতু পুরোপুরো পানিতে ডুবে থাকার কারণে হতাশা ব্যাক্ত করেছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
কক্সবাজার থেকে বেড়াতে আসা পর্যটক নিবিলাস দাশ বলেন, রাঙামাটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটটি এভাবে পানিতে ডুবে থাকবে এটা আশা করা যায় না। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা শুধু এই সেতুটিই দেখতে আসেন, কিন্তু তাদের হতাশ হয়ে ফেরত যেতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের এটা নিয়ে ভাবা উচিত।
চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে আসা আরেক পর্যটক রুহুল আমিন বলেন, আমরা পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছি। আমরা শুনেছিলাম যে সেতুতে পানি উঠেছে, কিন্তু এখানে এসে দেখতে পাচ্ছি পুরো সেতুই পানির নিচে। এটা দেখে আমরা খুব হতাশ হয়েছি। কর্তৃপক্ষের এটা সংস্কার করা উচিত। কারণ এই এক সেতুই রাঙামাটিকে উপস্থাপন করে। এভাবে সেতু ডুবে যাওয়া রাঙামাটির পর্যটন শিল্পের জন্য ক্ষতিকারক।
বিজ্ঞাপন
দীর্ঘদিন সেতু ডুবে থাকার কারণে ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়েছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। পর্যটক না থাকায় ট্যুরিস্ট বোট চালক থেকে শুরু করে সেতু এলাকায় বসা ভ্রাম্যমাণ পাহাড়ি পণ্যের দোকানদার সবার মুখেই হাতাশার ছাপ পড়েছে।
ট্যুরিস্ট বোট চালক আবদুস সোবাহান বলেন, এই মৌসুমটা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সময়ে ঝর্ণা, লেক দেখার জন্য রাঙামাটিতে পর্যটকরা আসেন। কিন্তু এবারের বর্ষা আমাদের জন্য হতাশার। সেতু ডুবে যাওয়ার খবর সারা দেশে প্রচার হয়ে যাওয়ায় পর্যটক নেই বললেই চলে। আমরা সম্পূর্ণ অলস সময় পার করছি। এভাবে চলতে থাকলে কয়েকদিন পর আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।
সেতু এলাকায় হাতে বোনা ব্যাগ ও পাহাড়ি ফলমূল বিক্রি করেন কণিকা চাকমা। তিনি বলেন, ব্রিজ ডুবে যাওয়ার পর থেকে একটা দিনও ভালো বেচাবিক্রি হয়নি। কোনো দিন তো এক টাকাও বিক্রি হয়নি। কারণ এখন পর্যটক আসে না। কবে পানি কমবে আর পর্যটক আসবে আমি এখন সেই দিন গুনছি।
রাঙামাটি ট্যুরিস্ট বোট মালিক সমিতির সহ-সভাপতি ও রাঙামাটি পর্যটন ঘাটের ইজারাদার মো. রমজান আলী বলেন, আজ ২৫ দিন হলো ব্রিজ পানির নিচে। প্রথমদিকে যেই পরিমাণ পানি ছিল আমরা আশা করেছিলাম কিছুদিনের মধ্যে পানি কমে যাবে। কিন্তু টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে পানি আরও বেড়ে এখন ব্রিজ একেবারে ডুবে গেছে। প্রথমদিকে কিছু পর্যটক আসলেও এখন আর পর্যটক আসে না। এই যে টানা তিন দিনের বন্ধে পর্যটকে ভরপর থাকার কথা ছিল রাঙামাটি, কিন্তু সেই পরিমাণ পর্যটক নেই শহরে। আমরা খুবই হতাশায় দিন পার করছি।
কেন বারবার ডুবে যায় এই সেতু এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, রাঙামাটি শহরের একদম শেষ প্রান্তে অবস্থিত দুটো পাহাড়কে সংযুক্ত করে ১৯৮৫ সালে নির্মিত হয় এই ‘ক্যাবল স্টে ব্রিজটি’। প্রায় ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে এই সেতুটি দাঁড়িয়ে আছে মোটা ক্যাবল এবং দুই প্রান্তের চারটি পিলারের ওপর। সেতুটির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানই এই সেতুটির নকশা ও নির্মাণ করেছে বলে পর্যটন কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু সেই সময় হ্রদের পানির উচ্চতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানটিই সেতুটি স্থাপনের উচ্চতা নির্ধারণে সমস্যা করে। ফলে নির্মাণ কাজ শেষে উদ্বোধনের দুই বছর পরই ১৯৮৭ সালে সেতুটি পানির নিচে ডুবে যায় বর্ষা মৌসুমে। সেই থেকে প্রায় নিয়ম করেই যে বছর ভারী বৃষ্টিপাত হয় সেই বছরই পানির নিচে ডুবে যায় সেতুটি। পাশাপাশি কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পানি সংরক্ষণ করে রাখার জন্য যখন বাঁধের স্লুইসগেটগুলো বন্ধ করে রাখা হয় তখনো অতিরিক্ত পানির কারণে ডুবে যায় সেতুটি।
এ বিষয়ে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী বিরল বড়ুয়া বলেন, এই সেতুটি এখন সংস্কার করতে গেলে যেই ব্যয় হবে তা দিয়ে আরেকটি নতুন সেতু তৈরি করা সম্ভব। কারণ সেতুটি উপরে উঠাতে গেলে ক্যাবল ও পিলারগুলো লোড নেবে না। এই সেতু বাদে আমরা আরও একটি নতুন সেতু তৈরির কথা ভাবছি। এ ব্যাপারে একটি কারিগরি কমিটিও গঠিত হয়েছে। আশা করছি আমরা খুব শিগগিরই কিছু একটা করব।
রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা বলেন, আমরা মোটামুটি আশানুরূপ পর্যটক পেয়েছি এই তিন দিনের বন্ধে। আমাদের হোটেল-মোটেল মিলিয়ে প্রায় ৯০ শতাংশ রুম বুকিং হয়ে গেছে। যদিও ব্রিজ পানিতে ডুবে আছে, তবুও পর্যটকদের উপস্থিতি মোটামুটি আছে।
তিনি আরও বলেন, ৩ সেপ্টেম্বর থেকে আমরা বিজ্রে প্রবেশের যে টিকিট সেটি বিক্রি বন্ধ রেখেছি। তবুও কোনো পর্যটক যদি দূর থেকে ব্রিজ দেখতে প্রবেশ করেন, আমরা বাধা দিচ্ছি না। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হোটেল-মোটেল ৯০ শতাংশ বুকিং থাকবে।
মিশু মল্লিক/আরএআর