নওগাঁয় ঢলন প্রথার নামে ৪২ কেজিতে মণ হিসেবে মাছ কেনাসহ ওজনে কারসাজির অভিযোগ উঠেছে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। এতে মাছ চাষিদের লাভের বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে ঢলনে। বিষয়টি নিয়ে মৎস্য চাষিদের সঙ্গে যৌথভাবে আপত্তি জানিয়েছে আড়তদাররাও। আড়তে মাছ কেনাবেচায় ডিজিটাল ওজন মেশিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করাসহ অবিলম্বে ঢলন পদ্ধতি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন তারা।

পৌর মৎস্য আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির তথ্যমতে, এক সময় মাছ উৎপাদনে পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে উত্তরাঞ্চলে মাছ উৎপাদনের বৃহত্তর জেলাগুলোর মধ্যে একটি নওগাঁ। এই জেলা শহরের বৃহত্তর মাছ কেনাবেচার হাট পৌর মাছ বাজার। যেখানে প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত বাজারের ২২টি আড়তে দূরদূরান্ত থেকে ভটভটি ও পিকআপ যোগে মাছ বিক্রি করতে আসেন মৎস্য চাষিরা। এই আড়তে সশরীরে উপস্থিত থেকে অথবা নিজ নিজ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে মাছ কেনেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে এই বাজারে মাছ কিনতে আসেন বাইরের ব্যবসায়ীরাও। মাছ কেনার পর বাইরের ব্যবসায়ীরা এসব সরবরাহ করেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।

মৎস্য চাষিদের অভিযোগ, দীর্ঘ ৫০ বছরের এই বাজারে মাছ বিক্রি করতে আসা ব্যবসায়ীদের কাছে মাছ বিক্রির প্রথম শর্ত থাকে ঢলন। প্রতি মণে কমপক্ষে ২ কেজি মাছ অতিরিক্ত দেওয়ার শর্তে রাজি হলে তা পরিমাপ করা হয় কাঁটা দাঁড়িপাল্লায়। যেখানে প্রতি মণ মাছে ৪ কেজির বেশি মাছ নেয় ব্যবসায়ীরা। এভাবে ঢলন প্রথার নামে ওজনে কারসাজি করে প্রতিনিয়ত মৎস্য চাষিদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। এর প্রতিবাদ করতে গেলে সিন্ডিকেট করে মাছ কেনা বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন রোববার দুপুরে সরেজমিন শহরের গোস্তহাটির মোড় পৌর মাছ বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঢলন প্রথার প্রতিবাদ জানানোর কারণে ওই বাজারে দূরদূরান্ত থেকে যাওয়া মাছ চাষিদের ওপর চড়াও হচ্ছেন পাইকারি মাছ ব্যবসায়ীরা। বিষয়টি নিয়ে আড়তদার ও মাছ ব্যবসায়ীদের মাঝে চলছে বিরোধ। দুই পক্ষের মধ্যকার এই দ্বন্দ্বে সকাল থেকেই আড়তে বাহিরের অনেক ব্যবসায়ীদের ঢুকতে দেননি স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীরা। এছাড়াও অনির্দিষ্টকালের জন্য মাছ কেনা বন্ধ রাখার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পাইকারি মাছ ব্যবসায়ীরা। এতে পরিবহনযোগে বিক্রি করতে আনা বেশির ভাগ মাছ ফেরত নিয়ে যাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েছেন মৎস্য চাষিরা। অন্যদিকে বাজারে মাছের সংকট সৃষ্টি হওয়ায় বেশি দামে মাছ কিনতে গিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা।

শহরের নওগাঁ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান বলেন, মাছ কিনতে এসে দেখছি বাজার মাছশূন্য। একটা গণ্ডগোলের মতো পরিস্থিতি হয়ে আছে। যে দু’একটা দোকানে মাছ বিক্রি হচ্ছে সেখানে দাম অনেক চড়া। যেহেতু পুরো বাজারে মাছ নেই তাই বাধ্য হয়ে ১৮০ টাকা কেজি দামের বাটা মাছ ৩২০ টাকা কেজি দরে কিনতে হলো।

আরজী নওগাঁ মধ্যপাড়া থেকে মাছ কিনতে আসা রিকশাচালক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, পুরো বাজার ঘুরে ২টা দোকানে পাঙাস মাছ দেখতে পেলাম। তাও দাম ২০০ টাকা কেজির নিচে না। অথচ দু-দিন আগেও এই মাছ ১৬০ টাকা কেজি দরে কিনেছি। মাছের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির সুযোগে ব্যবসায়ীরা চড়া দাম হাঁকছেন।

সাগর হোসেন নামে এক মাছ চাষি এসেছিলেন শহরের চকপ্রাণ মহল্লা থেকে। তিনি বলেন, রুই, কাতলা ও পাঙাসসহ প্রায় ৩০ মণ মাছ বিক্রির জন্য এনেছিলাম। অন্যদিনে ২ ঘণ্টার মধ্যেই বিক্রি শেষ হয়ে যায়। অথচ দুপুর পেরিয়ে গেলেও অর্ধেক মাছও বিক্রি হয়নি। যেটুকু বিক্রি হয়েছে সবটুকুই বাইরের জেলার ব্যবসায়ীরা কিনেছেন। বাকিটা অন্য হাটে ফেরত নিয়ে যেতে হচ্ছে।

সদর উপজেলার দুবলহাটি ইউনিয়নের দুবলহাটি গ্রাম থেকে আসা মৎস্য চাষি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখন মাছ উৎপাদনে খরচ বেড়ে গেছে। তাই ৪০ কেজির জায়গায় ৪২ কেজি মাছ দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মাছে ঢলন প্রথা ঠেকাতেই হবে। মাছ ফেরত নিয়ে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় প্রথমবারের মতো অর্ধেক দামে বাইরের ব্যবসায়ীদের কাছে মাছ বিক্রি করতে হয়েছে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

নওগাঁ পৌর আড়তদার মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গৌতম হাওলাদার ভুট্টু বলেন, দৈনিক এই আড়তে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকার মাছ কেনা-বেচা হয়। এখানকার স্থানীয় পাইকারি ব্যবসায়ীরা সারাবছর ওজনে কারসাজি করে ঢলনের নামে অতিরিক্ত মাছ নেয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশনা ছিল ১ সেপ্টেম্বর থেকে ডিজিটাল ওজন মেশিনে মাছ কেনা-বেচা করতে হবে। সেই মোতাবেক ডিজিটাল ওজন মেশিনে মাছ বিক্রি করতে গেলে সকালে মাছ কেনা বন্ধ করে দিয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পাইকারি মাছ ব্যবসায়ী আফাজ উদ্দিন সরদার ও শরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দাঁড়ি পাল্লায় ওজন করে ঢলনে মাছ কিনলে অতিরিক্ত কিছু মাছ পাওয়া যায়। এই ঢলন নেওয়ার একমাত্র কারণ ওই মাছের সঙ্গে কিছু পানি উঠে আসে। ঢলন না নিলে মাছ কিনে আনার পর ওজন করলে ওজন কমে যায়। এছাড়াও ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রির সময় কয়েক গ্রাম করে মাছ বেশি বিক্রি করতে হয়। কিন্তু ডিজিটাল ওজন মেশিনে ঢলন নিলেও আমাদের পোষাবে না। এই বাজারে এমনিতেই মাছের দাম বেশি। তাই বাইরে থেকে কিছু মাছ কিনে এনে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আপাতত এই আড়ত থেকে মাছ কেনা বন্ধ।

নওগাঁ জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির খবর পাওয়ার পরই সরেজমিন সেখানে গিয়ে তদন্ত করে এসেছি। সেখানে যাওয়ার পর মাছের সরবরাহ অনেক কম পেয়েছি। অনেক মাছ চাষি মাছ বিক্রি করতে এসে মাছ ফেরত নিয়ে গেছেন। ঢলন পদ্ধতি সম্পূর্ণ অবৈধ। উভয়পক্ষকে নিয়ে বৈঠকের পর সমস্যা সমাধান না হলে কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী ঢলন প্রথা বাতিলসহ বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরমান হোসেন রুমন/এএএ