ফরিদপুরের সালথায় সহিংসতার ঘটনায় আহত মিরান মোল্যা (৩৫) নামের আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার ভাওয়াল ইউনিয়নের দরজাপুরুরা গ্রামের আবদুর রব মোল্যার ছেলে। বুধবার (৭ এপ্রিল) দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মিরান মোল্যা। মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভাওয়াল ইউপি চেয়ারম্যান ফারুকুজ্জামান ফকির মিয়া। এ নিয়ে সহিংসতায় দুজনের মৃত্যু হলো।

সহিংসতার ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোছা. তাসলিমা আলী ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আসলাম মোল্লাকে প্রধান করে ৬ সদস্যবিশিষ্ট দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার ঢাকা পোস্টকে জানান, সালথায় তাণ্ডবের ঘটনা তদন্তে ছয় সদস্যের দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর একটিতে প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোছা. তাসলিমা আলীকে। অপর কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আসলাম মোল্যাকে। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে এই দুই কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার (৮ এপ্রিল) দুপুরে সালথায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।

এর আগে বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন, মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী আইভি মাসুদ, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদুল হক, দিপক মজুমদারসহ যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা।

জানা যায়, ফরিদপুরের সালথায় সহিংসতার ঘটনায় ৪ হাজারেরও বেশি লোককে আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। বুধবার সকাল ৮টার দিকে সালথা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মিজানুর রহমান বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এতে আসামি হিসেবে ৮৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। আর অজ্ঞাত আসামি করা হয় ৪ হাজার জনকে। 

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামাল পাশা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, থানায় হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি করে। মামলার এজাহারভুক্ত ১৩ আসামিকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের দ্রুত গ্রেফতার করা হবে।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন, মামলার এজাহারভুক্ত আসামি উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের গোপালিয়া গ্রামের ক্বারী ইনছুর শেখের ছেলে মো. নুরু শেখ (১৮), বিনোকদিয়া গ্রামের করিম কাজীর ছেলে মো. সজিব কাজী (১৯), ইউসুফদিয়া গ্রামের শাহজাহান মাতুব্বরের ছেলে রাব্বি মাতুব্বর (১৯), মিনাজদিয়া গ্রামের আব্দুল মোতালেবের ছেলে মো. ইউনুস মাতুব্বর (৬০), গোপালিয়া গ্রামের সালাম মোল্যার ছেলে আমির মোল্যা (৩০)।

এ ছাড়া ফুকরা গ্রামের গ্রামের সুলতান শেখের ছেলে আবুল কালাম শেখ (৩৫), রিপন শেখ (৩২), ইসরাইল মোল্যার ছেলে ইলিয়াস মোল্যা (২৭), চিলারকান্দা গ্রামের খালেক শেখের ছেলে শহিদুল শেখ (৩২), পিসনাইল গ্রামের গ্রামের ঝিলু ফকিরের ছেলে মো. রুবেল ফকির (২৫), সোনাপুর গ্রামের মিজানুর শেখের ছেলে মো. রাকিবুল ইসলাম (১৮) ও বিনোকদিয়া গ্রামের আইয়ুব মোল্যার ছেলে মো. সাইফুল ইসলামকে (১৮) গ্রেফতার করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা পরিদর্শন করছেন

অন্যদিকে ধংসযজ্ঞ শেষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও এলাকার অবস্থা এখনো থমথমে। উপজেলা পরিষদ জুড়ে এখনও পড়ে আছে শুধুই ক্ষত-বিক্ষত চিহ্ন। উপজেলা সদরের বাতাসে পোড়া গন্ধ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ভাঙা কাঁচ আর আসবাবপত্রের টুকরা। মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। টানা তিনঘণ্টা তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপজেলা পরিষদ এলাকা। ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যাক পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। 

এদিকে সহিংসতার ঘটনায় ৪ হাজারেরও বেশি লোককে আসামি করে মামলা দায়ের হওয়ায় এলাকা জনশুন্য হয়ে পড়েছে। সদর এলাকায় লোকজনের আনাগোনা একবারেই নেই বললেই চলে। রাস্তাঘাট একেবারেই ফাঁকা রয়েছে। 

প্রসঙ্গত, ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় করোনা মোকাবিলায় কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকর করতে দুই আনসার সদস্য ও ব্যক্তিগত সহকারীকে নিয়ে সালথা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারুফা সুলতানা খান হিরামণি ফুকরা বাজারে যান। সেখানে তিনি যাওয়ার পর মানুষের জটলা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় তিনি ওই স্থান থেকে ফিরে আসেন এবং সেখানে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল পাঠান। ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত জনতা এসআই মিজানুর রহমানের ওপর হামলা চালান। এতে তার মাথা ফেটে যায়।

পরে স্থানীয় জনতা পুলিশের গুলিতে দুজন নিহত ও বাহিরদিয়া মাদরাসার মাওলানা আকরাম হোসেন এবং জনৈক আরেক মাওলানার গ্রেফতারের গুজব ছড়িয়ে দেয়। এতে হাজারো মানুষ এসে থানা ঘেরাও করে। পরে 0উপজেলা পরিষদ, থানা, সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন, উপজেলা কৃষি অফিস, সাবরেজিস্ট্রার অফিস, উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) গাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় সালথা উপজেলা সদর এলাকা।

পরে সালথা থানার পাশাপাশি ফরিদপুর, বোয়ালমারী, ভাঙ্গা ও নগরকান্দা থানার পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার সদস্যরা যৌথভাবে ফাঁকা গুলি ও টিয়ারশেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আট সদস্যসহ আহত হন ২০ জন। তাদের মধ্যে জুবায়ের হোসেন (২৫) নামের এক যুবক চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কয়েকটি মসজিদের মাইক থেকে এবং বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোন থেকে ফেসবুক লাইভে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন নিহত ও মাওলানাকে গ্রেফতারের গুজব ছড়িয়ে হাজার হাজার মাদরাসা ছাত্র, মুসল্লি ও জনতাকে ডেকে জড়ো করা হয় উপজেলা পরিষদ চত্বরে। এরপর দফায় দফায় হামলা চালানো হয় বিভিন্ন সরকারি দফতরে। সোমবার রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত চলে এ তাণ্ডব।

সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাসিব সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্থানীয় জনতা পুলিশের গুলিতে নিহত ও মাওলানাকে গ্রেফতারের পর তাকে মারপিট করা হচ্ছে বলে গুজব ছড়িয়ে দেয়। এমন গুজবে হাজারো মানুষ এসে থানা ঘেরাও করে। পরে আমার বাসভবন, উপজেলা পরিষদ, সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দফতরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। 

সালথা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওয়াদুদ মাতুব্বর বলেন, গুজব ছড়িয়ে এ হামলা চালানো হয়েছে। সুপরিকল্পিতভাবে বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের নেতাকর্মীরা এ হামলা চালিয়েছেন।

ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে অপরাধীদের শনাক্তের চেষ্টা করছি, প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরও জানান, এলাকায় পুলিশ-র‌্যাবের পাশা-পাশি বিজিবি মোতায়েন রয়েছে।

বি কে সিকদার সজল/এনএ