পিরোজপুরে নারকেলের বাম্পার ফলন হয়। এখানকার নারকেল দেশের চাহিদার বিশাল অংশের জোগান দেয়। নারকেল থেকে তৈরি হয় সুস্বাদু খাবার ও তেল। আর এর ছোবড়া জ্বালানি ছাড়াও জাজিম, পাপোশ, রশি, সোফা ও চেয়ারের গদিসহ বিভিন্ন ধরনের শৌখিন ও প্রয়োজনীয় পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এসব তৈরিতে নারকেলের ছোবড়ার বেশ কদর রয়েছে এ জেলায়।

পিরোজপুর বরিশাল বিভাগের একটি নদীবেষ্টিত অঞ্চল। এই নদীগুলোকে ঘিরেই পিরোজপুর জেলার মানুষের জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত হয়। পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে নানা শিল্পকারখানা। আর সেই শিল্পের মধ্যে সম্ভাবনাময় একটি খাত হলো নারকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি পাপোশ ও ম্যাট।

জানা যায়, নেছারাবাদ উপজেলার বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের আওতায় অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা থেকে বিসিক উদ্যোক্তা গড়ে তোলে প্রতিবছর। তবে পাপোশ তৈরি একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। নারকেলের ছোবড়া মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে পাপোশ তৈরিতে। বর্তমানে নারকেল শুকানোর আগেই কচি থাকতে তার ব্যবহার বেশি হওয়ায় শুকনা নারকেলের ছোবড়া কম পাওয়া যায় এবং যা পাওয়া যায়, তারও অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন ছোবড়া ব্যবসায়ীরা।

অনেকের মতে, এই ছোবড়াশিল্পটি শত বছরের পুরোনো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান সরকারের প্রতিষ্ঠিত ‘কয়ার ইন্ডাস্ট্রি’ ব্যক্তিমালিকানায় চলে যায়। বর্তমানে ‘রানা-রাব্বী ইন্ডাস্ট্রি’ নামে এটি চলছে। এ শিল্প এলাকায় আরও পাঁচটি ছোবড়াশিল্পের আধুনিক কারখানা গড়ে উঠেছে।

নেছারাবাদ উপজেলায় ছোবড়া থেকে দড়ি তৈরি হয়। দড়ি থেকে তৈরি করা হয় ক্রিকেট মাঠের ম্যাট, যা পিরোজপুর জেলাসহ সারা দেশের ম্যাটের চাহিদা মেটাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে।

পাপোশ তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরেরা

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন বিসিক পিরোজপুরের তথ্যমতে, বর্তমানে বিসিক শিল্প নগরে মোট ১৬৭টি প্লট আছে, যার মধ্যে বরাদ্দকৃত প্লটসংখ্যা ১৪৪, বরাদ্দকৃত শিল্প ইউনিট ৯৯টি, উৎপাদনরত শিল্প ইউনিট ৫৯টি এবং ২৬টি প্লট বরাদ্দের অপেক্ষায় আছে।

নারকেলের ছোবড়া কারখানার শ্রমিক মো. মাছুম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে আমরা ছোবড়ার ব্যবসা করি। এটা দিয়ে পাপোশ হয়। ব্রাশের তুলি, চিকন কাতড়া হয়। ছোবড়ার গুঁড়ি মেহগনি, চাম্বল, মাল্টাসহ বিভিন্ন গাছের চারার গোড়ায় দিতে লাগে। মোটামুটি লাভ হয়। বস্তা ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু কচি ডাব কেটে ফেলায় নারকেল পাওয়া যায় কম। এ জন্য আমাদের ক্ষতি হচ্ছে।

আরেক শ্রমিক মিরাজ ব্যাপারী বলেন, ভান্ডারিয়া, তুষখালীসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে নারকেলের ছোবড়া আনি আমরা। তারপর মেশিন দিয়ে আঁশ বানাই। আঁশ শুকাতে দিই আর গুঁড়ি বস্তায় ভরে বিক্রি করি। প্রতি বস্তা বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায়।

পাপোশশ্রমিক আবদুল কাদের বলেন, পাপোশের কাঁচামাল আমরা বাজার থেকে কিনে আনি। তারপর কারখানায় তৈরি করে এগুলোকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাই দিই। ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে আমাদের এই কারবার চলছে। এখানকাার আয় দিয়েই আমাদের সংসার চলে।

দীর্ঘদিন ধরেই এ গ্রামের মানুষ কুটিরশিল্পের ব্যবসা করে আসছেন। তারা এই পাপোশের কাঁচামাল জোগাড় করেন ইন্দেরহাটসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে। তাদের বাড়িতে অনেক কারিগর থাকেন। বিশেষ করে নারীরাই কাজে বেশি অংশ নিয়ে থাকেন।

এমনটা জানিয়ে নিখিল চন্দ্র বলেন, পুরুষরা এ কাজ কম করে। পাপোশ তৈরি করে বাজারে নিয়ে গেলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতা আসেন। তারা কিনে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাই দেন। সরকার যদি আমাদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করত, তাহলে আমরা আরও ভালো ব্যবসা করতে পারতাম।

এ বিষয়ে দ্য পিপলস কয়ার ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী মো. মহিউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্রিকেট ম্যাট দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো। একটি ম্যাটের দাম বর্তমানে ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো। নারকেলের ছোবড়া সংগ্রহ করে আনা হয় বাগেরহাট থেকে। তারপর রশি পাকিয়ে ম্যাট বানানো হয়। ম্যাটশিল্পে ৩ থেকে ৪ ও পাপোশশিল্পে ৫ থেকে ৬ জন শ্রমিক কাজ করেন। বছরে ২৫ থেকে ৩০টা ম্যাট চলে। ছোট পাপোশগুলো বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্লাই করা হয়।

থরে থরে সাজানো ডোর পাপোশ

পিরোজপুর জেলা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন বিসিক কর্মকর্তা মিল্টন বৈরাগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন বিসিক পিরোজপুর আমরা উদ্যোক্তা তৈরি করি। অর্থাৎ উদ্যোক্তা চিহ্নিতকরণ থেকে শুরু করে তাদের প্রশিক্ষণ, ঋণ কার্যক্রম পর্যন্ত বিসিক কাজ করে থাকে। তাদের প্লট বরাদ্দদান, প্রজেক্ট প্রোফাইল, লেআউট প্ল্যানসহ সবকিছুই আমরা উদ্যোক্তাদের জন্য করি।

তিনি বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরের আমরা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ১৫০ জন উদ্যোক্তাকে বাছাই করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। পরে দেখা যাচ্ছে এখান থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ উদ্যোক্তা সফল হয়েছেন। তবে তাদের ঋণের চাহিদা রয়েছে। ব্যাংকের নিয়মকানুন মেনেও তারা ঋণ পাচ্ছেন না। অথচ বিসিক থেকে নামমাত্র ঋণ পৌঁছে দিই উদ্যোক্তাদের। এরপর তাদের শিল্পের উৎপাদিত পণ্যগুলো নিয়ে বছরে একাধিকবার মেলার আয়োজন করি।

এই কর্মকর্তা বলেন, ঐক্য ফাউন্ডেশন নামে উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য অনলাইনে ডিসপ্লে করে বিক্রি করার আমাদের একটা মাধ্যম রয়েছে। আমরা প্রথমে উদ্যোক্ত চিহ্নিত করি। অবজারভেশনের মাধ্যমে আমরা দেখি যে কার কার বয়স শেষ হয়ে গেছে। যারা চাকরির চেষ্টা করে, তারা সাধারণত উদ্যোক্তা হয় না। তবে ৩০ বছরের বেশি বয়সীদের আমরা উদ্যোক্তা হিসেবে চিহ্নিত করি। পরে তাদের প্রশিক্ষণের জন্য একটা ভাইভা নেওয়া হয়। তারপর তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।

এনএ