বিদেশে যাওয়ার পথে সাগরে নৌকায় অবৈধভাবে যেতে অস্বীকৃতি জানায় কালাম। সে দালালদের অনেক রিকোয়েস্ট করে বলেছিল-‘আমাকে বিদেশ নিয়েন না। আমি যেতে চাই না। কিন্তু দালালরা তাকে বলেছে, এখানে আসা যায়, কিন্তু যাওয়া যায় না।’ নৌকায় কালামের সঙ্গে ছিল এমন কয়েকজন দেশে ফিরে কথাগুলো জানিয়েছিল আমাদের। তারা বলেছে, আমার ভাই জীবিত আছে। তাদের কথা বিশ্বাসও হয়েছিল আমাদের। কিন্তু খোঁজ না থাকলে যা হয়। দীর্ঘ ১২ বছর পরে থাইল্যান্ডে এক জেলখানার বন্দিদের সঙ্গে ছবিতে ভাইকে দেখে ফিরে পাওয়ার আসা নতুন করে জেগেছে।

ঢাকা পোস্টকে এভাবেই বলছিলেন, ২০১৩ সালের ২১ অক্টোবর নিখোঁজ হওয়া আবুল কালামের বড় ভাই আব্দুল খালেক। খালেক সিরাজগঞ্জের বেলকুচির আজগাড়া গ্রামের বাসিন্দা হলেও বর্তমানে তিনি রাজশাহী পবা উপজেলার হরিয়ান এলাকায় বসবাস করেন। কালাম সাত ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। এসএসসি পাস করে বিদেশে অবৈধভাবে পারি জমাতে গিয়ে নিখোঁজ হন আবুল কালাম।

তিনি আরও বলেন, আমরা তো ভেবেছিলাম ভাই মারা গেছে। এক বছর আগে আমরা একটা ছবি পাই। একটি জেলখানায় অনেকগুলো বন্দির মধ্যে আমার ভাইও আছে। এই ছবিটি মালেয়েশিয়ার কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়। আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনি বলেছিলেন ছবিটি অন্যজনের কাজ থেকে পেয়েছেন। এরপরে আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র জমা দেই। বিষয়টি নিয়ে থানায় ডায়েরি করি। কোনো সন্ধান মেলেনি। আমি শুনেছি, থাইল্যান্ডে প্রায় ১৫ হাজারের মতো মানুষ বন্দি আছে। আমরা এখনও সেইভাবে জানতে পারিনি আমার ভাই কোন জেলখানায় আছে। তবে ভাইকে ফিরিয়ে দেবে বলে একটি চক্র আমাদের থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

আব্দুল খালেক বলেন, ২০১৩ সালের দিকে ভাইকে (কালাম) বিদেশ পাঠানোর জন্য এক জায়গায় টাকা দিয়েছিলাম। দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে যেতে না পাড়ায় টাকা ফেরত নেওয়া হয়। তখন ভাইকে বলেছিলাম, তোমাকে বৈধ পথে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করবো। তুমি একটু অপেক্ষা করো। তার পরেও সে (ভাই) গোপনে দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বিষয়টি পরিবারের কাউকে জানায়নি। সে বাড়িতে বলছে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে সে চিটাগাং (চট্টগ্রাম) যাবে। চট্টগ্রাম যাওয়ার দুই-তিন পরে জানতে পারলাম ভাই মালেয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সেখানে (চট্টগ্রাম) গেছে। পরে আমি তাকে (ভাইকে) ফোন দিলাম। ফোন তিনবার রিসিভ হয়। কিন্তু কোনো কথা হয়নি। তারপরে ফোন দিলেও রিসিভ হয়নি। আমি তাকে ফিরে আসতে বলবো বলে সে আমার ফোন রিসিভ করেনি। তারপরে ফোন বন্ধ পাই। এখন পর্যন্ত ফোন বন্ধ।

তিনি বলেন, পরে জানতে পারি চট্টগ্রামের এক দালালের মাধ্যমে সে গেছে। ওই দালাল বিদেশে মানুষ পাঠায়। যারা ফিরে এসেছে তারা বলেছিল ভাই যে জাহাজে যাচ্ছিল সেই জাহাজে প্রায় ৯০০ জনের মতো ছিল। তারা সবাই বিদেশে যাচ্ছিল। জাহাজে কি হয়েছে সেটা জানি না। তবে শুনেছি, তাদের মধ্য থেকে অনেকেই জেল খেটে দেশে ফেরত এসেছেন। আমাদের গ্রামের যারা ফিরে এসেছেন তারা বলেছেন, জাহাজে তোলার আগে নৌকায় তুলেছিল অনেককেই। আমার ভাই দালালদের অনেক অনুরোধ করেছিল, আমাকে নিয়েন না (বিদেশে)। আমি যেতে চাই না বিদেশে। ফিরে যাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু পারেনি।

মা সবসময় আশায় থাকতেন ছেলে ফিরে আসবে। ছেলের দেখা পাবে। আমাদের আশেপাশের এলাকায় বিদেশ থেকে কেউ এলে আমার মা (রূপভানু) ছুটে যেতেন। মনে করতেন বিদেশ ফেরত সেই মানুষকে তার ছেলের ছবি দেখালে কোনো সন্ধান যদি পাওয়া যায়। টেকনাফ, কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় মা গিয়ে খোঁজ করেছেন ভাইয়ের। আমরাও গেয়েছি অনেকবার। ২০১৫ সালে আমি (আব্দুল খালেক) হজে গিয়েছিলাম। সঙ্গে আমার মা ছিল। মা বিদেশিদের কালামের ছবি দেখিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে, এটা তার ছেলে, সে হারিয়ে গেছে। আপনারা তাকে চেনেন কিনা। যদিও আমার মা বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা জানতেন না।

তিনি আরও বলেন, নৌকা পথে তিন দিন পাড় হয়েছে। তাদের নৌকায় অনেক লোক ছিল। দালালরা রাতে আরেকটা টলারে কিছু লোক নেয়। ১০-১২ জনের গ্রুপের মধ্যে আমার (আব্দুল খালেক) ভাই আলাদা একটা নৌকায় পাড় হয়। তারপরে এই গ্রুপের সঙ্গে তার আর যোগাযোগ নেই। বেঁচে আছে না, মারা গেছে এটাও কেউ বলতে পারে না। দীর্ঘদিন থেকে আমরা বিভিন্নভাবে তাকে খোঁজার চেষ্টা করছি। তার কোনো সন্ধান পাইনি। আমরা কোনো সময় শুনি সে মিয়ানমারে আটক আছে। কখনও শুনি সে থাইল্যান্ডে আটক আছে।

আব্দুল খালেক বলেন, আমাদের প্রত্যাশা- আমার ভাই আমাদের মাঝে ফিরে আসুক। তাকে ফিরে আনতে আমরা সব ধরনের খরচ বহন করবো। আমরা আশাবাদি সে থ্যাইল্যান্ডের জেলখানায় আটক আছে। তবে থ্যাইল্যান্ডের কোন জেলখানায় আটক আছে আমরা তা জানি না। এটা জানতে পারলে আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। সরকার পদক্ষেপ নিলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চেষ্টা কররে আমরা আমাদের ভাইকে দ্রুত ফিরে পাবো।

এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই। তবে এমন কোনো আবেদন এলে আমরা আমাদের মতো করে সাহায্য করার চেষ্টা করবো। তবে সে অবৈধভাবে গেলে আমাদের দিক থেকে তেমন কিছু করার থাকবে না। তবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক নামে একটি শাখা আছে। পাচার হয়ে থাকলে সেই ডেস্কে অভিযোগ বা আবেদন দিলে তারা সাহায্য পাবেন।
 
এ নিয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেইন প্রোগ্রামের সিরাজগঞ্জের ফিল্ড অর্গানাইজার শরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছেলেটি পাচার হয়ে থাকলে তার জেলে বন্দি থাকার কথা নয়। হয়তো কোনো অপরাধ করে থাকতে পারে। তবে তার যাওয়ার কাগজপত্র ও বাংলাদেশে লিগ্যাল অভিভাবক থাকলে আমরা তাকে আমাদের মাধ্যমে সরকারিভাবে ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। তবে তার পরিবার চাইলে সকল কাগজপত্রসহ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আমরা সাধ্যানুযায়ী সহযোগিতা করবো। 


শাহিনুল আশিক/এমএএস