ভারতের উজান থেকে ভাটির দিকে ধেয়ে আসা তিস্তার প্রবল স্রোতে রংপুরের গঙ্গাচড়া এলাকার স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি করা গ্রামরক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে বেশ কয়েকটি ঘর-বাড়ি ও গাছ-পালা ভেসে যাওয়ার পাশাপাশি কয়েক শ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) দুপুরে গঙ্গাচড়া লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের ইছলি চর এলাকায় এই চিত্র দেখা যায়।

স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার দিবাগত ভোররাত ৪টার দিকে বাঁধটি ভেঙে যায়। এতে সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি ঘর-বাড়ি, গবাদিপশু, গাছ-পালা, পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ার পাশাপাশি ফসলের ক্ষেত নষ্ট হয়। তবে বাঁধ রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগও উঠেছে। 

আবার পানি বৃদ্ধি পেলে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণে কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এদিকে পানি বাড়া-কমার পাশাপাশি কিছু কিছু এলাকার নদী ভাঙন দেখা দেওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা।

ইছলি চর, শংকরদাহ ও বিনবিনার চরের মামুদ মিয়া, আজগর আলী, নজিবর হোসেনসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, বাঁধ নির্মাণ না হলে এখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু বিদ্যালয়ই নয়, এখানে বাঁধ না থাকায় চাষাবাদের জমিসহ আশপাশের প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার মানুষ বসতভিটা নিয়ে ভাঙন ভীতিতে রয়েছে।

শংকরদাহ গ্রামের রবিউল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, বন্যার সময় সকলে আমাদের কষ্ট দেখতে আসে। বন্যার পর আর কেউ খোঁজ নেন না। খুব খারাপ লাগে যখন সব কিছু চোখের সামনে ভেসে যায়। অথচ একটা বাঁধ থাকলে আমরা বন্যার ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতাম। আমাদের এলাকার মানুষদের বানভাসি হতে হয় না। আমরা গ্রামবাসী বাঁধের জন্য ইউপি চেয়ারম্যান থেকে এমপি পর্যন্ত চিঠি দিয়েছি, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

পূর্ব ইছলি চরের কৃষক আবুল হোসেন বলেন, ‌‘বাঁধ হইলে খালি হামার মতো গরীব মাইনসের উপকার হবার নায়। যামরা মহিপুর-কাকিনা দিয়্যা সেতু ধরি যাওয়া আইসা করে ওমারো ভালো হইবে। শংকরদাহ থাকি বিনবিনা পর্যন্ত বাঁধ দেয়া জরুরী হইছে। বাঁধ নাইলে এবার হামারগুল্যার সাথে সাথে নয়া সেতুত যাওয়ার আস্তাঘাটের মারাত্মক ক্ষতি হইবে।’

স্থানীয়রা মনে করছেন, শংকরদাহে বাঁধ নির্মাণ না করা হলে বিগত সময়ের মত আবারও নবনির্মিত গঙ্গাচড়া শেখ হাসিনা সেতুর সংযোগ সড়ক হুমকিতে পড়বে। বিশেষ করে রংপুর ও লালমনিরহাটের সঙ্গে মানুষের যাতায়াতের জন্য মহিপুর-কাকিনা সংযোগ সড়কটি বিচ্ছিন্ন হবে।

এ ব্যাপারে লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদি বলেন, আমরা জানি না কি কারণে শংকরদাহ থেকে বিনবিনিয়া পর্যন্ত একটা বাঁধ করা হয়নি। অথচ বাঁধের জন্য কয়েকবার আবেদন করা হয়েছে। ডিও লেটার নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দিয়েছে। গত বন্যায় রংপুরের জেলা প্রশাসক এসে নিজে দেখে গেছেন। কিন্তু বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ দেখছি না।

বাঁধ নির্মাণ না হলে শংকরদাহ ও বিনবিনা চরের চল্লিশ হাজারের বেশি মানুষের বসত ভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে দাবি করে চেয়ারম্যান বলেন, এই ইউনিয়নে কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটা কলেজ, দুইটা মাদ্রাসা আছে।  স্থায়ী বাঁধ না হলে নদী ভাঙনে এগুলো হুমকির মুখে পড়বে। এখানকার ৬০ হেক্টর চাষাবাদের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল শংকরদাহ থেকে বিনবিনিয়া চর পর্যন্ত একটা বেরি বাঁধ নির্মাণ করা হোক। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড সেটি আজও করে দেয়নি। বরং আমরা নিজেরাই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি অস্থায়ী গ্রামরক্ষা বেরি বাঁধ তৈরি করেছিলাম। স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি করা সেই গ্রামরক্ষা বাঁধটি বৃহস্পতিবার ভোরে ভেঙে গিয়ে কয়েকটি বাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। মানুষজনের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।

আব্দুল্লাহ আল হাদি আরও বলেন, ভারত থেকে আসা উজানের পানিতে এখানকার চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বেশিরভাগ আমন ধানের ক্ষেতসহ শীতকালীন শাক-সবজির আবাদি জমি পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। প্রতিবছর এমনটা হয়ে আসছে। বন্যা হলেই আমার ইউনিয়নের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু বারবার বলার পরও পানি উন্নয়ন বোর্ড আমাদেরকে একটি স্থায়ী বেরী বাঁধ নির্মাণ করে দেয়নি। অথচ নদীশাসনের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। এর আগে ২০১৭ সালে একবার বাঁধ ভেঙে গিয়ে এই এলাকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। আবার সেই একই অবস্থা দেখা দিয়েছে। এখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা থাকেন, মন্দিরও রয়েছে। আমরা ভারতে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি দেখে ভীষণ ভয়ে আছি। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তা নদী বেষ্টিত রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা। এই উপজেলার মানুষ প্রতি বছরই যুদ্ধ করে নদী ভাঙনের সঙ্গে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও আর খরার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তাই এখানকার নদীপাড়ের মানুষরা বন্যা শব্দটি শুনলেই আঁতকে উঠেন। ভয় পান নতুন করে আবার কিছু না হারায়।

নদী ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণের দাবি অনেক পুরোনো। যে দাবিতে সাড়া দিয়ে বিগত সময়ে কিছু বাঁধ নির্মাণ হলেও বাদ পড়েছে বরাবরই অধিক ঝুঁকিতে থাকা শংকরদাহ গ্রাম। এ গ্রামে বাঁধ নির্মাণ হয়নি। এ কারণে বন্যা দেখা দিলেই নড়ে চড়ে বসেন লক্ষীটারী ইউনিয়নের মানুষ। প্রতি বছরই বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয় এখানে।

বৃহস্পতিবার সকালে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি পূর্ব ইছলি চরের লোকজনদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করেন। তার সঙ্গে উপজেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তামান্না নাহিদ বলেন, স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত গ্রামরক্ষা বাঁধটি ভেঙে তেমন ক্ষতি হয়নি। দুই-তিনটি ঘর পানিতে ভেঙে গেছে। এছাড়া বন্যার পানিতে প্রায় ১০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, এই বন্যাটি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এ জন্য আমরা জনগণকে সতর্ক করেছি। তাদের ধান-চাল, হাঁস-মুরগি, গবাদি পশুসহ প্রয়োজনীয় মালামাল বিভিন্ন স্কুলকলেজ এবং আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও উঁচু জায়গায় নেওয়া হয়েছে। উঁচু স্কুলগুলোতে আমরা এরই মধ্যে থাকার জন্য ব্যবস্থা করে রেখেছি।

এদিকে রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, রংপুরের গঙ্গাচড়া এলাকার বাঁধ ভাঙার খবর পেয়েছেন তারা। এটি স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত হওয়ায় মেরামতে কোনো বরাদ্দ নেই তাদের।

পাউবো সূত্র বলছেন, উত্তর সিকিমে তিস্তা নদীর চুংথাং বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বুধবার সকাল থেকে বাংলাদেশ প্রান্তে নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর আগে মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে গজলডোবা পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি ২৮৫ সেন্টিমিটার এবং দোমুহুনী পয়েন্টে বুধবার সকাল থেকে ৮২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অন্য নদীর পানিও। এতে রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার তিস্তা নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলো প্লাবিত হয়ে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ্দৌলা বলেন, বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫১ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার)। একই সময়ে কাউনিয়া পয়েন্টে পানি সমতলে বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৫ সেন্টিমিটার (স্বাভাবিক ২৮ মিটার ৭৫ সেন্টিমিটার) নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএএ