স্বামী-স্ত্রীর প্ররোচনা
সৌদি গিয়ে বিপাকে ১১ ব্যক্তি, দিশাহারা পরিবার
‘আমার স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। দুই মেয়ে নিয়ে সুখেই যাচ্ছিল দিনকাল। একদিন আমার স্বামী প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের বাড়িতে গেট তৈরির কাজে যায়। বিদেশে গেলে রাজমিস্ত্রির কাজ করে ভালো বেতন পাওয়া যাবে বলে আমার স্বামীকে জানান জাহাঙ্গীরের স্ত্রী। বাড়িতে এসে আমার স্বামী এ কথা জানালে নিষেধ করি। কিন্তু তিনি আমার কথা না শুনে সৌদি আরবে গিয়ে এখন মরুভূমিতে পড়ে আছে। আর আমি দুই মেয়ে নিয়ে দেশে ভেসে আছি।’
এভাবেই ঢাকা পোস্টকে বলছিলেন নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চরকাদহ গ্রামের সৌদি প্রবাসী সাজেদুল মোল্লার স্ত্রী সেলেনা বেগম।
বিজ্ঞাপন
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি আমার স্বামীকে বিদেশ যেতে দেব না দেখে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী আমাদের বাসায় আসে। আমাকে বলে বিদেশে যেতে দিবে না ক্যা? গেলে অনেক টাকা কামাই করবি। দেখোনা আমার স্বামী কত টাকা কামাই করতিছে। তোমার স্বামী ভালো মিস্ত্রি, দেশে ৫০০ টাকায় কামাই করে। বিদেশ গেলে মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন আইসবি। তারপরও আমি স্বামীক বিদেশ যেতে বারণ করি। কিন্তু আমার স্বামী বিদেশ যাবেই। ঘরে টাকা না থাকায় সুদের ওপর চার লাখ টাকা এনে আমার স্বামী বিদেশ (সৌদি আরব) গেল।’
তিনি আরও বলেন, আমার স্বামী বিদেশ গিয়ে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে নয় মাস কাজ করল। কিন্তু একটা টাকাও দেয়নি। এদিকে বাড়িতে একটা চালও নেই। অন্যদিকে কিস্তির টাকার জন্য লোকজন বাড়িতে এসে বসে থাকে। পরে স্থানীয় নেতাদের ধরে একটা চালের কার্ড করেছি এবং মানুষের বাড়িতে কাজ করে খাই। এদিকে বিদেশ যাওয়ার কয়েক মাস পর জাহাঙ্গীর আবার টাকা চায়। টাকা চেয়ে আমার স্বামীকে মারধর করে এবং নানাভাবে তার ওপর অত্যাচার চালাতে থাকে। স্বামী আমাক ফোন দিয়ে বলে আমাকে চাও নাকি টাকা চাও? পরে স্বামীর রেখে যাওয়া ১০ কাঠা জমি বিক্রি করে আবার পাঁচ লাখ টাকা জাহাঙ্গীরের স্ত্রীর কাছে দিয়ে আসি। সব মিলিয়ে নয় লাখ টাকা দিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার স্বামীকে আকামা কার্ড (কাজের অনুমতিপত্র) করে দেয়নি। আমার স্বামী এখনো মরুভূমিতে পড়ে আছে।
বিজ্ঞাপন
শুধু সেলেনা বেগম নয় জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে সৌদি আরব গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়ে ওই গ্রামের আরও ছয়টি পরিবারসহ মোট ১১টি প্রবাসী পরিবার এখন সর্বস্বান্ত।
অভিযোগ উঠেছে, উপজেলার ধারাবারিষা ইউনিয়নের চরকাদহ গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম (৪৫) ও তার স্ত্রী রওশনারা বেগমের (৩৫) মাধ্যমে একই গ্রামের মেহের আলীর ছেলে মিজানুর রহমান, মৃত এছকেন প্রামাণিকের ছেলে সাইফুল ইসলাম, মৃত ছলিম মোল্লার ছেলে সোহাগ মোল্লা, মৃত গোলু মোল্লার ছেলে সাজেদুল মোল্লা, মৃত সের মোহাম্মদের ছেলে সাজেদুল ইসলাম, লোকমান প্রামাণিকের ছেলে মোন্তাজ আলী এবং একই উপজেলার তাড়াশিপাড়া গ্রামের শুনজান শাহ’র ছেলে সমশের আলী, মৃত হাসানের ছেলে মোবারক আলী, হাঁসমারী গ্রামের মৃত শহিদুলের ছেলে এনামুল প্রামাণিক, বেড়গঙ্গারামপুর গ্রামের আতাহার প্রামাণিকের ছেলে মতিউর রহমান ও নাটোর সদরের বড়ভিটা এলাকার খলিলের ছেলে রুবেল হোসেন সৌদি আরবে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন।
পরিবারগুলোর অভিযোগ, সৌদি আরবে নেওয়ার আগে ভালো বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী। অধিকাংশ জনই দুই থেকে আড়াই বছর আগে সৌদি আরবে গেলেও আকামা (কাজের অনুমতিপত্র) না পাওয়ায় কর্মহীনভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় দেশেও ফিরতে পারছেন না তারা।
এদিকে পাঠানোর সময় জমি লিজ, সুদের টাকা ও ধারদেনা করে পাঠানো পরিবারগুলোর ঋণের বোঝা বাড়ছে চক্রবৃদ্ধি হারে। অনেক পরিবার ঋণের ফাঁদে আটকে বিক্রি করেছেন ভিটেমাটি।
ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজন ও এলাকাবাসী জানান, বিষয়টি নিয়ে অনেকবার সালিশ বসলেও এর সুরাহা হয়নি।
এ বিষয়ে চরকাদহ গ্রামের প্রধান মফিজ উদ্দিন ও আবু হানিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারগুলো নিম্নবিত্ত। পরিবারের একটু সুখের আশায় ঋণ করে পাড়ি জমায় প্রবাসে। সেখানে গিয়ে টাকাপয়সা পাঠাতে না পেরে প্রত্যেকটি পরিবার এখন ঋণগ্রস্ত। জমিজমা বন্ধক দিয়ে, বিক্রি করে বিপদে পড়েছে। অনেক দিন ধরেই ওই সকল পরিবার আমাদের কাছে এসব অভিযোগ নিয়ে আসে। পরে জাহাঙ্গীর আলম সম্প্রতি দেশে এলে গত মাসের ২৮ তারিখ গ্রামে সালিশ বসে। সেখানে কতজনকে জাহাঙ্গীর আলম এভাবে বিদেশে পাঠিয়েছে এমন প্রশ্ন করলে সে চুপ থাকে।
ঢাকা পোস্টকে আবু হানিফ বলেন, অন্য একটি মারফতে জানতে পারি সে (জাহাঙ্গীর) ১০-১২ জনকে পাঠিয়েছে। পরে সালিশে ভুক্তভোগী প্রতিটি পরিবারকে এক লাখ টাকা করে দেওয়ার রায় হয়। কিন্তু জাহাঙ্গীর সেই টাকা দিতে না চাইলে আমরা ভুক্তভোগীদের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলি।
মিজানুর রহমান নামের আরেক ভুক্তভোগীর স্ত্রী তানিয়া খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বামীকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা বলে ২০২১ সালে সৌদিতে নিয়ে যায়। সেসময় বাড়িতে টাকা না থাকায় সুদের ওপর চার লাখ টাকা দিই। নিয়ে যাওয়ার পর প্রথম নয় মাস আমার স্বামীকে বসিয়ে রাখে। তখন বাড়ি থেকে তার খাওয়ার খরচ দিয়েছি। তারপর জাহাঙ্গীর আবার বলে সামনের নয় মাসের চার মাস কাজ হবে আর পাঁচ মাস বসে থাকতে হবে। এর মধ্যে বাড়িতে কিস্তির টাকার জন্য এনজিওর লোকজন এসে বসে থাকে, সুদের টাকার জন্য অত্যাচার শুরু করে। একপর্যায়ে আমি আত্মহত্যার চিন্তা করি। যাওয়ার ১৮ মাস পরে আবার আমার থেকে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা চায় জাহাঙ্গীর। বলে টাকা না দিলে আমার স্বামীকে মেরে ফেলবে। পরে বাধ্য হয়ে আবার গ্রামের কয়েকজনকে ডেকে দুই লাখ টাকা দিই। আর ৭০ হাজার টাকা ব্যবস্থা করতে না পারায় দিতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সঙ্গে জাহাঙ্গীর প্রতারণা করেছে। আমি থানায় অভিযোগ দিয়েছি, পুলিশকে ফোন দিয়ে বলেছি। তারা বলে গ্রামে মীমাংসা হবে। কিন্তু গ্রামের প্রধানরা বিচার করতে পারেনি।
আরেক ভুক্তভোগী সাইফুল ইসলামের স্ত্রী রিক্তা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই বছর আগে ছোট মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে জাহাঙ্গীরের লোভ দেখানো কথায় পাঁচ লাখ টাকা লিজ ও সুদের ওপর নিয়ে তাদের দিয়ে সৌদিতে যান আমার স্বামী। কিন্তু এই দুই বছরে আমার স্বামী এক টাকাও পাঠাতে পারেনি। এখন বাচ্চাকে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন পার করছি। বর্তমানে ওই পাঁচ লাখ টাকার ঋণ বাড়তে বাড়তে ১০ লাখ টাকা হয়ে গেছে। এখন শুনছি নতুন করে আকামা কার্ড করতে ৫-৬ লাখ টাকা লাগবে। এখন আগের ঋণের টাকাই দিতে পারছি না নতুন করে এত টাকা কীভাবে দেব।
ভুক্তভোগী এনামুল প্রামাণিকের স্ত্রী আজেদা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভবিষ্যৎ ও সংসারের সুখের আশায় বিদেশে যাওয়ার সময় দুই বছর আগে জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী রওশনারা বেগমের হাতে চার লাখ টাকা দিয়েছিলেন আমার স্বামী। এরপর এনামুলকে সৌদি আরবে পাঠানো হলেও তিনি মূলত প্রতারণার শিকার হয়েছেন। পাঠানোর নয় মাস পরে আমার স্বামীর ওপর অত্যাচার চালিয়ে আবারও দুই লাখ টাকা দাবি করলে আমি আমাদের বসতভিটা বিক্রি করে দুই লাখ টাকা দিই। নিরুপায় হয়ে বিক্রি করা বাড়িতেই থাকতেছি। কিন্তু যাদের কাছে বিক্রি করেছি তারা বাড়ি ছাড়ার জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, গত চার দিন ধরে আমার স্বামীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এখন আমি আর কিছু চাই না। শুধু আমার স্বামীকে উদ্ধার করে দেশে এনে দিক।
বর্তমানে জাহাঙ্গীর আলম দেশে আছেন। তার কাছে গেলে তিনি কি বলেন এমন প্রশ্নে আজেদা বেগম বলেন, আমি তার কাছে গিয়ে বলেছি কিছু টাকা দেন অন্তত বাড়িটা উদ্ধার করি। তিনি উল্টো অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই পরিচয় দেওয়া বিল্টু প্রামাণিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাহাঙ্গীর প্রথমে চার লাখ টাকায় তাদের বিদেশ নিয়ে গেছে। তাদের নয় মাস করে কাজ করিয়ে টাকা দেয়নি, আবার আকামা কার্ডও দেয়নি। পরে তাদের আটকে অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে আবার অনেকের থেকে ৩-৪ লাখ করে টাকা নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমার হাত দিয়েও দুই-তিনবার ভুক্তভোগীর পরিবার জাহাঙ্গীরকে তাদের টাকা দিয়েছে। স্বামী বিদেশে থাকায় প্রত্যেক নারী বিপদে আছে। অন্যের বাড়িতে কাজ করছে। এ ঘটনায় তদন্ত সাপেক্ষে সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাচ্ছি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে গেলে জাহাঙ্গীর আলমকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে তার স্ত্রী রওশনারা বেগম এসব অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো তাদেরকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলে ঢাকা পোস্টকে জানান।
রওশনারা বেগম বলেন, যারা আমার স্বামীর মাধ্যমে সৌদি আরব গেছে তারা প্রত্যেকেই কাজ করছে। যারা এগুলো বলছে তারা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। আমার শাশুড়ির ক্যানসার হওয়াতে আমার স্বামী কিছু দিনের জন্য দেশে এসেছে। কিন্তু তাদের (ভুক্তভোগী পরিবার) অত্যাচারে আমার স্বামী বাড়িতে থাকতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, আমার স্বামী ২০ বছর বিদেশ থেকে শুধু একটা বাড়ি করেছে। বরং যাদের সৌদি আরবে নিয়ে গেছে তাদের খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য খরচ বাবদ এখান থেকে ৩০ লাখ টাকা ঋণ করে আমি পাঠিয়েছি।
এ বিষয়ে গুরুদাসপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনোয়ারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ধারাবারিষা ইউনিয়নের চরকাদহ গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের মাধ্যমে সৌদি আরবে গিয়ে বেশ কয়েকজন প্রতারিত হয়েছে বলে কয়েকজন দাবি করছে। এমন কয়েকটি অভিযোগও এসেছে। বিষয়টি নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সেইসঙ্গে বিদেশে যারা যাচ্ছেন তাদেরকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার পরামর্শ দেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে কথা বলতে নাটোরের পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এমজেইউ