গোপালগঞ্জ সদরের কাজুলিয়া গ্রামের লালন শেখ ও তার ভাতিজা রাশেদুল শেখ চাকরি করেন সৌদি আরবের নাদিম শহরে। সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা মি. আবু বন্দরের একটি ভাঙারি মালামালের প্রতিষ্ঠানে। চাচা লালন শেখ ৮ বছর ও ভাতিজা রাশেদুল শেখ ৫ বছর ধরে কাজ করছেন সেখানে। দীর্ঘদিন একই প্রতিষ্ঠান কাজ করার সুবাদে মালিক (কফিল) আবু বন্দরের সঙ্গে একটা সখ্যতা গড়ে উঠে চাচা ও ভাতিজার। দু‌’জনেই অর্জন করেছেন সৌদি মালিকের আস্থা ও ভালবাসা। তাইতো সেই সম্পর্কের টানে কর্মচারীর রাশেদুলের বিয়ের দাওয়াত নাকচ করতে পারেননি। ছুটে এসেছেন বাংলাদেশে।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর সকালে সৌদি আরবের একটি ফ্লাইটে করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন সৌদি নাগরিক আবু বন্দর ও প্রবাসী লালন শেখ। পরে সেখান থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে গোপালগঞ্জের কাজুলিয়া গ্রামের পল্লী মঙ্গল ইউনাইটেড একাডেমি অ্যান্ড কলেজে মাঠে এসে নামেন তারা। সেখানে সৌদি নাগরিক আবু বন্দরকে দেখতে ভিড় করেন উৎসুক জনতা। ফুলের মালা দিয়ে অভিনন্দন জানান গ্রামবাসী। কয়েকদিনে আবু বন্দর ঘুরেছেন সুন্দরবন, কুয়াকাটাসহ দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। 

বৃহস্পতিবার ৫ অক্টোবর দুপুরে কর্মচারী রাশেদুলের সঙ্গে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বরযাত্রী হয়ে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া পৌরসভার রতাইল এলাকায় অবস্থিত কনের বাড়িতে যান আবু বন্দর। কর্মীর বিয়েতে সৌদি মালিক অংশ নেওয়ায় বর ও কনের বাড়িতে ছিল উৎসবের আমেজ। সৌদি নাগরিককে দেখতে ভিড় করেন বিয়ে বাড়ির অতিথিরা। ভিনদেশিদের এমন ব্যতিক্রম বিয়ের আয়োজন দেখে কিছুটা অবাক সৌদি নাগরিক আবু বন্দরও। হালকা মসলাযুক্ত খাবারে অভ্যস্ত হলেও বিয়ে বাড়ির মেনুতে থাকা সকল খাবারই খেয়েছেন তৃপ্তি সহকারে। খাবার শেষে সৌদির নিয়ম অনুযায়ী কোলাকুলি করে নিজ কর্মীকে অভিনন্দন ও তার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা জানান। 

কর্মচারীর প্রতি ভালবাসা ও নিজের মহানুভবতায় দেখিয়ে বিয়ে বাড়িতে অতিথিদের অবাক করেছেন আবু বন্দর। খুশি কনের পরিবারের সদস্যরাও। বুধবার সন্ধ্যায় রাশেদুলের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে অংশ নেয় আবু বন্দর। সেখানে রাশেদুল গায়ে হলুদ মাখাসহ গভীর রাতে পর্যন্ত অনুষ্ঠান উপভোগ করেন এই সৌদি নাগরিক। শুক্রবার রাশেদুলের বৌভাতের অনুষ্ঠানেও অংশ নেবেন তিনি। বিয়ের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফিরে যাবেন নিজ দেশ সৌদি আরবে। 

কর্মচারীর বিয়েতে এসে কেমন লাগলো এমন প্রশ্নে আবু বন্দর বলেন, আমার খুবই ভালো লেগেছে। রাশেদুলের বিয়েতে আসতে পেরে আমি সবচেয়ে খুশি। তিনি শুধু আমার কর্মচারী না আমার ভাইয়ের মতো। 

সৌদি বিয়ে আর বাংলাদেশের বিয়ের পার্থক্য কি জানতে চাইলে আবু বন্দর বলেন, আমাদের দেশে বিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় রাতে এশার নামাজের পর। শেষ করতে হয় ফজরের আগে। ৫-৬ ঘণ্টায় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বিয়ের চিত্র ভিন্ন। এখানে দুই তিনদিন ধরে বিয়ের অনুষ্ঠান করে। এরা বিয়েতে অনেক আনন্দ করার সুযোগ পায়। নাচ গান করে। কিন্তু ধর্মীয় বিষয়টির (কাবিন ও মোনাজাত) সঙ্গে অনেকটা মিল আছে। আর খাবারের সঙ্গেও কিছুটা মিল রয়েছে।

বাংলাদেশি বিয়ের খাবার খেতে কেমন লেগেছে এবং সৌদিতে কি কি খাবার পরিবেশন করা হয় জানতে চাইলে বলেন, আমার কাছে বিয়ের খাবার খেতে খুবই ভালো লেগেছে। আমি খুব তৃপ্তি করে খেয়েছি। আমাদের দেশের চাইতে খাবারে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। আমাদের দেশে বিয়ের খাবারের মেনুতে কখনো মাছ থাকে না। এদেশে দেখছি মাছ আছে। এছাড়া বেশিরভাগ বিয়েতে আমাদের ঐতিহ্যবাহী বিরিয়ানি রাখা হয়। 

বাংলাদেশ কেমন লাগলো এবং কতদিন থাকবে জানতে চাইলে আবু বন্দর বলেন, বাংলাদেশ খুবই সুন্দর একটা দেশ। এদেশের এই সবুজ শ্যামল প্রকৃতি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। বেশ কয়েক জায়গায় ঘুরেছি। আর সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। এখন থেকে মনে করবো বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় বাড়ি। বিয়ে শেষ করে চলে যাব। হয়ত আর তিন থেকে চারদিন আছি। এরপর নিজ দেশে ফিরে যাবো। 

বর রাশেদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি আর আমার চাচা সৌদি নাগরিক আবু বন্দরের প্রতিষ্ঠান চাকরি করি। কিছুদিন আগে দেশে আসার পর পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে ঠিক হয়। পরে চাচার মাধ্যমে ও আমি নিজেই মালিককে দাওয়াত পাঠাই। পরে তিনি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমার বিয়েতে এসেছেন। তিনি এসে আমার বিয়ের আনন্দ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার কফিল (মালিক) আমার বিয়েতে সৌদি থেকে এসেছেন এতে আমি ধন্য। 

কনের চাচা ও কোটালীপাড়া পৌরসভার কাউন্সিলর কবীর হাওলাদার বলেন, এর আগে আমাদের এই অঞ্চলে কোনো বিয়েতে বিদেশি নাগরিক আসে নাই। এবারই প্রথম। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে কর্মচারীর প্রতি সৌদি মালিকের ভালবাসা দেখে। সত্যিই আমরা মুগ্ধ হয়েছি। 

আশিক জামান/এএএ