ছোট ছোট সবুজ পাতা। গাছের ফাঁকে ফাঁকে সাদা ফুল। মধু ভরা ফুলে ভ্রমরের আনাগোনা। বাতাসের দোলে দোল খায় পথেঘাটে ও পতিত জমিতে জন্ম নেওয়া এই গাছটি। প্রাকৃতিকভাবে জন্ম হয় গুল্ম জাতীয় ছোট এই উদ্ভিদটির। এর সাদা ফুল মুখে নিলে মিষ্টি স্বাদ অনুভূত হয়। পাতা চিবালে মুখে তেতো স্বাদ লাগবে। কোনো কোনো এলাকায় এটি শাক হিসেবে রান্নাও হয়। ছোট গুল্ম উদ্ভিদটির নাম ‘শ্বেতদ্রোণ’ বা ‘দণ্ডকলস’।

বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এ উদ্ভিদটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। কোনো এলাকায় ‘মধু গাছ’ বা ‘কানশিসা’ আবার কোথাও ‘কানশিকা’ নামে পরিচিত। তবে এই গাছের আসল নাম ‘শ্বেতদ্রোণ’। এ গাছের উচ্চতা ১ থেকে দেড় মিটার হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কয়েকটি গাছ একত্রে জন্মে ঝোপালো ভাবে। সারা বছরই এ গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এর ফুল ফোঁটার আদর্শ সময় মার্চ ও মে।

সম্প্রতি রংপুর নগরীর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সরেয়ারতল এলাকাসহ বিভিন্ন সড়কের দু’পাশে এবং অনাবাদি জমিতে দণ্ডকলসের বিচরণ সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে। দণ্ডকলস উদ্ভিদটি কখনো এককভাবে রোপণ করতে হয় না। এটি প্রাকৃতিকভাবে অন্য ফসলের সঙ্গে সাথি শাক বা গাছ হিসেবে জন্মায়। এ কারণে কোথাও কোথাও একে সাথি শাকও বলা হয়। সবার সঙ্গে মিলে মিশে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করে দণ্ডকলস।

সরেয়ারতল এলাকার কৃষক বুলবুল মিয়া জানান, প্রাকৃতিক পরিবেশে এমনিতেই দণ্ডকলস বেড়ে ওঠে। এটি চাষাবাদ বা রোপণ করতে হয় না। এটি সাধারণত মাটি থেকে একহাত পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এই গাছের পাতা গাঢ় সবুজ রঙের এবং কাণ্ড হালকা সবুজ হয়ে থাকে। পরিপক্ব গাছে ধবধবে সাদা রঙের ফুল থাকে। ফুলের মধু মিষ্টি হওয়ায় মৌমাছির আনাগোনা থাকে। গ্রামের শিশুরা মধুর লোভের এই ফুল মুখে নিয়ে মিষ্টি স্বাদ নেন।

সরেয়ারতল বাজার থেকে একটু সামনে গেলেই চোখে পড়বে বিশাল বাগান। সেখানে সুপারি, নারিকেল, আম, লিচু, পেঁপেসহ বিভিন্ন গাছের সমারোহ রয়েছে। এই বাগানের ঝোপঝাড়সহ আশপাশের ফসলি ও অনাবাদি জমিতেও দেখা গেছে দণ্ডকলসের ছড়াছড়ি। সেখানে কথা হয় বাগান মালিকের ছেলে জহুরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, দণ্ডকলসের ফুল থেকে সবুজ রঙের ফল হয়। এই ফল পাকলে ফলের ভেতরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কালো রঙের বীজ হয়ে থাকে। বীজ থেকেই বংশবৃদ্ধি ঘটে। ছোট এ গাছের নানা ধরনের ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে।

বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ কাইজেলিয়ার চারা উৎপাদনকারী ও কারমাইকেল কলেজের সাবেক মালি বাটুল সিং বলেন, দিন দিন কমে যাচ্ছে দণ্ডকলস উদ্ভিদটি। আগে ব্যাপকহারে সড়কের ধারে, মেঠোপথে, পতিত জমিতে আর বিভিন্ন ফসলের বাগানে এই গাছ দেখা যেত। কিন্তু এখন দণ্ডকলস আর তেমন দেখা যায় না। এই উদ্ভিদটি রক্ষা করা এখন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় দণ্ডকলস প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, এখন গ্রামের কৃষিজমিতে দণ্ডকলস তেমন চোখে পড়ে না। কারণ যে সব ফসলের সঙ্গে সাথি হয়ে জন্মায় সেসব ফসল কৃষক এখন আর তেমন চাষ করে না। এই গুল্মটির যে কি গুণ তা হয়ত আমরা অনেকেই জানি না। প্রাণবৈচিত্র্য হারালে এই গুল্মজাতীয় উদ্ভিদটির গুণ ও হারিয়ে যাবে। তাই সাথি ফসল করে এদের প্রাণবৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখা খুবই প্রয়োজন।

দণ্ডকলসের ঔষধিগুণঃ

গ্রামীণ চিকিৎসায় দণ্ডকলস ব্যাপকহারে ব্যবহার হয়ে থাকে দাবি হারবাল চিকিৎসকদের। তাদের তথ্য মতে, শহুরে জনপদে দণ্ডকলস খুব বেশি পরিচিত না হলেও গ্রামের মানুষের কাছে এটি উপকারী উদ্ভিদ হিসেবে বেশ সমাদৃত। এই উদ্ভিদে রয়েছে নানা ঔষধি গুণ। দণ্ডকলস কখনো শাক হয়ে, কখনো জুস হয়ে, কখনো ভর্তা হয়ে আমাদের কাছে আসে। পাতা তিতা হলেও এই ফুলের মধু মিষ্টি। এর গুণাগুণ না জেনেই গ্রামের ছোট শিশুরা ফুল তুলে চুষে চুষে মধু খায়।

সর্দি ও কাশি হলে এই গাছের পাঁতা সিদ্ধ করে কালোজিরা দিয়ে খেলে উপশম হয়। কাশি হলে দণ্ডকলসের পাতা ও শিকড় রস করে আদাসহ গরম পানি দিয়ে খেলে কাশিও কমে যায়। ছোট বাচ্চাদের যদি দীর্ঘ সময় সর্দি থাকে তাহলে এই গাছের ফুল তুলে সেই ফুল মায়ের বুকের দুধের সঙ্গে কচলিয়ে সেই দুধ খাওয়ালে সর্দি ভাল হয়ে যায়। পাতা বেটে রস করে মায়ের দুধের সঙ্গে মিশিয়ে মাথার তালুতে দিয়ে রাখলেও সর্দি কমে যায়।

বাচ্চাদের কৃমি হলে দণ্ডকলসের পাতা রস করে ১ চামচ করে ৪-৫ দিন খাওয়ালে কৃমি মরে যাবে। চুলকানি রোগেও কাজ করে দণ্ডকলস। এর পাতার রস কাঁচাহলুদের রস ও নারকেল তেল মিশিয়ে শরীরে মেখে রোদে শুকিয়ে গোসল করলে উপকার পাওয়া যায়। শিশুদের পাতলা পায়খানা হলে এই পাতার রস করে খাঁটি মধু মিশিয়ে দুই তিন দিন খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়। চুলকানি হলেও এই পাতার রস কাঁচাহলুদের রসের সঙ্গেি নারকেল তেল মিশিয়ে শরীরে মাখিয়ে কিছুক্ষণ রোদে শুকিয়ে গোসল করলে ভাল উপকার পাওয়া যায়। এই ভাবে এক সপ্তাহ পর্যন্ত লাগাতে হবে।

রংপুর মহানগরীর দেশ হারবাল এর হাকিম শফিকুর রহমান চৌধুরী জানান, গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ দণ্ডকলস একসময় গ্রামীণ চিকিৎসায় ব্যাপকহারে ব্যবহার হতো। এখনও হারবাল ওষুধ তৈরিতে এগুলো ব্যবহার হয়। নতুন প্রজন্মের অনেকেই এই গাছ সম্পর্কে জানে না। এ গাছটি সর্দি, কাশি, ব্যথা, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগের হারবাল ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।  

ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ এই গাছের বংশবৃদ্ধি ও রক্ষা করা দরকার বলে মনে করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে নদী ও পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৩৬ হাজার গাছ লাগিয়েছেন তিনি। সবুজায়নের জন্য জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারপ্রাপ্ত এই শিক্ষক জানান, শ্বেতদ্রোণ বা দণ্ডকলস এর গুণ না জানার কারণে আমাদের কাছে এর কদর নেই। কিন্তু গ্রামীণ জনপদে এখনো এই গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদটির ব্যবহার দেখা যায়।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএএ