হামলায় অংশ নিয়েছিল ৪-৫ হাজার মানুষ

গুজব ছড়িয়ে সোমবার রাতে ফরিদপুরের সালথায় তিন ঘণ্টাব্যাপী তাণ্ডব চালিয়ে সরকারি অফিস তছনছের ঘটনায় মামলা হয়েছে। তাণ্ডবে অংশ নেওয়া হাজার হাজার মানুষের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতপন্থীদের আধিক্য থাকলেও তাদের উসকে দেওয়ার নেপথ্যে ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীরা। 

সালথা উপজেলার কয়েক গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হামলায় অংশ নিয়েছিল ৪-৫ হাজার মানুষ। বাহিরদিয়া মাদরাসার মোহ্তামিম মাওলানা আকরাম আলীকে পুলিশ তুলে নিয়ে নির্যাতন করছে, এমন গুজব ছড়িয়ে হামলার উসকানি দেওয়া হয়। যদিও মাওলানা আকরাম এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

গ্রামের একাধিক মাতব্বর ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং জনপ্রতিনিধি জানান, প্রথমে ঘটনাটি সীমিত পরিসরে থাকলেও পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতার (দলে অনুপ্রবেশকারীদের) কারণে  ভয়াবহ রূপ নেয়। হামলায় যারা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন তাদের বুধবার সালথা উপজেলা পরিষদ চত্বর ও থানার আশপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয়রা।

স্থানীয়রা জানায়, ২৫ জানুয়ারি সালথা বাজারের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সরকারি জায়গায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গেলে উপজেলা প্রশাসনের ওপর ক্ষুব্ধ হন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ইমারত হোসেন পিকুল ও উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাদল হোসেন। ওই সময় ১৮টি অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দেয় প্রশাসন।

এ ঘটনায় পিকুল ও বাদল এবং তাদের সমর্থকরা ক্ষোভের কথা বিভিন্ন সময় প্রকাশ্যে ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করেছেন। সোমবারের ঘটনায় তারা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। হামলায় সরাসরি অংশ নেন এবং হামলাকারীদের অস্ত্র, ঢাল ও বাঁশ-কাঠ সরবরাহ করেন তারা।

গত ২৩ মার্চ রাতে সালথা প্রেস ক্লাবের নবনির্মিত ভবনের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়। এর নেপথ্যে ছিলেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ইমারত হোসেন পিকুল ও উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাদল হোসেন। যে জমিতে সালথা প্রেস ক্লাবের ভবন নির্মাণ করা হচ্ছিল সেই জমিটি পিকুল ও বাদল ভূমি অফিস থেকে লিজ নেওয়ার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু ভূমি অফিস জমিটি তাদের না দিয়ে প্রেস ক্লাবকে দেয়। এ কারণে আরও ক্ষিপ্ত হন তারা। এছাড়া পিকুল ও বাদল হোসেনের নামে রয়েছে নানা অভিযোগ।

সালথা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ইমারত হোসেন পিকুল বলেন, হামলায় আমি জড়িত নই। রামকান্তপুরের উত্তেজিত জনতাকে থামানোর চেষ্টা করেছি। তবে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে অসন্তোষ ও ফেসবুকে বিরূপ মন্তব্যের কথা স্বীকার করেন তিনি।

সালথা উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাদল হোসেন বলেন, হামলার সঙ্গে শুধু বিএনপির লোকজন জড়িত। আমি কিংবা আমার সমর্থকরা জড়িত নই।

সালথা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কাজী দেলোয়ার বলেন, তাণ্ডবে জড়িত বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজত। তবে নেপথ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীরাও জড়িত।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাওয়াল ইউনিয়নের ভাওয়াল গ্রামের বাচ্চু মাতুব্বর বলেন, ঘটনার সূত্রপাত ফুকরা বাজারে। সেখানে পল্লী চিকিৎসক কাউসারের সমর্থকরা এসিল্যান্ডের গাড়ি তাড়া করেছিল। কাউসার বিএনপির সমর্থক। তবে পরবর্তীতে ঘটনার উসকানি দেন সালথার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ওয়াহিদুজ্জামান ও তার সমর্থকরা।

তবে ওয়াহিদুজ্জামান উসকানি দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা আগে বিএনপি করলেও উল্লেখযোগ্য পদ ছিল না। হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করেছি আমরা। কিন্তু দলের মধ্যে কোন্দল থাকায় প্রতিপক্ষ আমাদের ফাঁসাতে চাইছে।

বল্লভদী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক নুরুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনা বিএনপি সমর্থকদের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

তিনি বলেন, বিভিন্ন এলাকার বিএনপির লোকজন হামলায় অংশ নেন। হামলার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীরা ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম মাঝারদিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও নগরকান্দা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাহিদুজ্জামান সাহিদ, তিনি বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।

তবে সাহিদুজ্জামান বলেন, হামলার বিষয়টি পরদিন জেনেছি। আমি সালথায় থাকি না, বর্তমানে ফরিদপুরে থাকি। আমার জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না।

হামলার প্রসঙ্গে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ওয়াদুদ মাতুব্বর বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী চক্র হামলায় যুক্ত। তবে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে আসা অনেক নেতা এ ঘটনায় জড়িত আছেন। হামলায় অংশ নেওয়া অনেকের প্রকাশ্যে ঘোরাফেরার বিষয়টি সত্য। আমরা অনেক কিছুই জানি। কিন্তু দলীয় অবস্থানের কারণে বলতে পারি না। 

তবে হামলায় বিএনপির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সালথা উপজেলা বিএনপির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান তালুকদার। প্রশাসন শুরু থেকেই ঘটনাকে পরিকল্পিত দাবি করলেও তিনি তা মানতে নারাজ। তার মতে, গুজব ছড়িয়ে হঠাৎ করেই ঘটনাটি ঘটিয়েছে স্থানীয় জনতা। 

এদিকে উপজেলার বিভিন্ন সরকারি অফিস ও থানায় তাণ্ডবের ঘটনা মামলা করেছে পুলিশ। মামলায় ৮৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও চার হাজার জনকে আসামি করা হয়। সালথা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মিজানুর রহমান বাদী হয়ে মামলাটি করেন। 

এ ঘটনায় মিরান মোল্যা (৩৫) নামের আহত আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার ভাওয়াল ইউনিয়নের দরজাপুরুরা গ্রামের আব্দুর রব মোল্যার ছেলে। বুধবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভাওয়াল ইউপি চেয়ারম্যান ফারুকুজ্জামান ফকির মিয়া। এর আগে এ ঘটনায় জুবায়ের হোসেন (২০) নামে এক যুবক মারা যান। সহিংসতায় এ পর্যন্ত দুজনের মৃত্যু হলো।

ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামাল পাশা বলেন, উপজেলা পরিষদ ভবন, ভূমি অফিস, মুক্তযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও থানা এলাকায় তাণ্ডবের ঘটনায় ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ মামলা করেছে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামিসহ ১৩ জনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের দ্রুত গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, সালথার তাণ্ডবের ঘটনা তদন্তে ছয় সদস্যের দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাসলিমা আলীকে, অপর কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আসলাম মোল্যাকে। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে দুই কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা আকরাম আলী বলেন, সোমবার রাতে চালানো তাণ্ডবের ঘটনা এখনো চোখে ভাসছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। 

স্থানীয় আরেক বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, সালথা দাঙ্গাপ্রবণ এলাকা হলেও এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। এ ধরনের তাণ্ডব প্রথম দেখল সালথাবাসী। এজন্য সবাই আতঙ্কে রয়েছেন।

প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সোমবার (০৫ এপ্রিল) সন্ধ্যায় করোনা মোকাবিলায় কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকর করতে দুই আনসার সদস্য ও ব্যক্তিগত সহকারীকে নিয়ে সালথা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারুফা সুলতানা খান হিরামণি ফুকরা বাজারে যান। সেখানে তিনি যাওয়ার পর মানুষের জটলা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় তিনি ওই স্থান থেকে ফিরে আসেন এবং সেখানে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল পাঠান। ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত জনতা এসআই মিজানুর রহমানের ওপর হামলা চালান। এতে তার মাথা ফেটে যায়।

পরে স্থানীয় জনতা পুলিশের গুলিতে দুইজন নিহত ও বাহিরদিয়া মাদরাসার মাওলানা আকরাম হোসেন এবং জনৈক আরেক মাওলানার গ্রেফতারের গুজব ছড়িয়ে দেয়। গুজবে কান দিয়ে হাজারো মানুষ এসে থানা ঘেরাও করে। সেই সঙ্গে উপজেলা পরিষদ, থানা, সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন, উপজেলা কৃষি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। 

এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) গাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সালথা উপজেলা সদর এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আট সদস্যসহ আহত হন ২০ জন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কয়েকটি মসজিদের মাইক থেকে এবং বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোন থেকে ফেসবুক লাইভে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন নিহত ও মাওলানাকে গ্রেফতারের গুজব ছড়িয়ে হাজার হাজার মাদরাসাছাত্র, মুসল্লি ও জনতাকে ডেকে জড়ো করা হয় উপজেলা পরিষদ চত্বরে। এরপর দফায় দফায় হামলা চালানো হয় বিভিন্ন সরকারি দফতরে। সোমবার রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত চলে এ তাণ্ডব। পরে সালথা থানা পুলিশের পাশাপাশি ফরিদপুর, বোয়ালমারী, ভাঙ্গা ও নগরকান্দা পুলিশ এবং র‌্যাব ও আনসার সদস্যরা যৌথভাবে ফাঁকা গুলি ও টিয়ারশেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

বি কে সিকদার সজল/এএম