সবার দুয়ারে গিয়ে মায়ের আকুতি- ‘আমার ছেলেটার একটু দায়িত্ব নেবেন?’
অসহায় মা তার অবুঝ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন তপ্ত দুপুরে। তখন ঘড়িতে ঘণ্টার কাটা ১২টার কোলে। মায়ের চোখেমুখে হতাশার ছাপ, কিন্তু হাসছেন ছেলে। এমন দৃশ্য দেখে বোঝার উপায় নেই ঘটনা আসলে কি। এরই মধ্যে অনেকের দুয়ারেও গেছেন অসহায় মা। কিন্তু কোথাও সাড়া মেলেনি।
সম্প্রতি (১০ অক্টোবর) রংপুর প্রেসক্লাব চত্বরে ছেলের হাত ধরে ঘুরতে দেখা যায় মনোয়ারা বেগমকে। সঙ্গে তার একমাত্র ছেলে মেরাজ হোসেন। পনেরো বছর বয়সী এ ছেলে জন্ম থেকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। সংসারে অভাব অনটনের কারণে ছেলের চিকিৎসা করানো তো দূরের কথা একটু পুষ্টিকর খাবার মুখে তুলে দিতে না পারার আক্ষেপে পুড়ছেন গর্ভধারণী মনোয়ারা। তাই সবার দুয়ারে পা রেখেই তার আকুতি, ‘আমার ছেলেটার একটু দায়িত্ব নেবেন’?
বিজ্ঞাপন
রংপুর নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের নূরপুর ছোট কবরস্থান এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে স্বামী-সন্তান নিয়ে মনোয়ারা বেগমের বসবাস। তার স্বামী পেশায় একজন রিকশাচালক। ছেলে মেরাজ হোসেন তার পূর্বের সংসারে জন্ম নেওয়া একমাত্র ছেলে সন্তান। নতুন সংসারে তার রয়েছে আড়াই বয়সের এক কন্যাশিশু। প্রথম স্বামীর মতো দ্বিতীয়জনেরও পেশা একই হওয়াতে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো দুরাবস্থা এখনো কেটে যায়নি। একারণে সন্তানের সুচিকিৎসা ও পুষ্টিকর খাবারের বন্দোবস্ত করার চেষ্টায় প্রতিদিন কারো না কারো দুয়ারে যাচ্ছেন অসহায় এই মা।
বিজ্ঞাপন
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলে মেরাজ হোসেনের চিকিৎসা করাতে না পেরে কষ্টে আছেন মা মনোয়ারা। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, গরিবের কপালে সুখ নেই। শুধু দুঃখ আর দুঃখ। ছেলেটার মুখের দিকে তাকালে স্বামী-সংসার কোনো কিছুতে আর শান্তি খুঁজে পাই না। চোখের সামনে আমার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলেটা দিনে দিনে কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে! ছোটবেলা থেকে ওর (ছেলের) ঠিক মতো চিকিৎসা করাতে পারিনি। ওর বয়স বাড়ছে, বড় হচ্ছে সেই অনুযায়ী ভালো পুষ্টিকর খাবারও খাওয়াতে পারছি না। আমার স্বামীর যা আয় করে তাতে কোনো রকমে দু’বেলা ভাত জোটে কিন্তু ভালো তরকারি খাবার প্লেটে থাকে না। ছেলেটার চিকিৎসা করা তো দূরের কথা একটু ফলমূল, মাছ-মাংসও ঠিক মতো খাওয়াতে পারি না।
তিনি আরও বলেন, জন্মের পর আমরা বুঝতে পারেনি আমার ছেলেটা রোগে আক্রান্ত। কয়েক বছর পর ওর (মেরাজের) চলাফেরা অন্য শিশুদের মতো না হওয়ায় আমরা বুঝতে পারি সমস্যা রয়েছে। তখন চিকিৎসা করাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু অর্থাভাবে সঠিক চিকিৎসা হয়নি। ছেলেকে পড়াশোনা করানোর ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়ে উঠেনি। এরই মধ্যে ২০১১ সালে আমার সংসার ভেঙে যায়। প্রথম স্বামীর সংসার থেকে বিতাড়িত হলেও আমি আমার ছেলেকে ছেড়ে আসিনি। এখন ওকে (ছেলেকে) চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি ভালো ভালো খাবার দেওয়াটাও খুব বেশি প্রয়োজন। এমনিতেই বুদ্ধি কম, তারমধ্যে যদি ঠিকমতো ভালো খাবার না পায় তাহলে আমার ছেলেটার ভবিষ্যতে কি হবে সেটা নিয়েই চিন্তায় আছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অসহায় মনোয়ারা বেগম আলমনগর এলাকার মৃত জিয়াউর রহমানের মেয়ে। তার মা জাবেদা বেগম। মনোয়ারারা তিন বোন। তার কোনো ভাই না থাকায় ছোটবেলা থেকেই সন্তানের হাল ধরার চেষ্টা করে গেছেন। বাবাহারা অভাবের সংসারে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাল্যবিয়ের শিকার হন মনোয়ারা। তার গর্ভে জন্ম নেয় মেরাজ হোসেন। পরবর্তীতে সংসার ভেঙে আরেক সংসারে মনোয়ারা ঘর বাধলেও বন্ধন অটুট না হওয়াতে ছেলেকে নিয়ে অনেকটাই বিপাকে রয়েছেন তিনি। ২০১৮ সাল থেকে সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রতিবন্ধী মেরাজ হোসেনকে ভাতা প্রদান করে আসছে। কিন্তু সেই টাকায় চিকিৎসা এবং নিয়মিত পুষ্টিকর দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না অসহায় এ পরিবারের পক্ষে।
নূরপুর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা সাদেকুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মেরাজের মা বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করে পরিবারকে চালানোর চেষ্টা করছে। তার স্বামীর আয়ে তো সংসার চলে না। চিকিৎসা করার কথা ভেবে লাভ কি? তাছাড়া আরেক ঘরের সন্তানকে এই ঘরে মেনে নেওয়ার একটা বিষয় রয়েছে। তবে ছেলেটাকে চিকিৎসার পাশাপাশি যদি পুষ্টিকর খাবার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে একটু হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো সম্ভব। গ্রামের মানুষজন যে যার মতো করে সহযোগিতা করে আসছে, কিন্তু সেটাতো সামান্য এবং সাময়িক সময়ের।
একই এলাকার রিকশাচালক মতিয়ার রহমান বলেন, ছেলেটার (মেরাজের) যদি গতি হয় তাহলে পরিবারটাও ভালো থাকবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সমাজসেবার ভাতা ছাড়া অন্য কোথাও থেকে তেমন বড় কোনো সহযোগিতা পায়নি ওই পরিবার। চিকিৎসাসহ ছেলের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য সমাজের বিত্তবান মানুষদের এগিয়ে আসা উচিত।
এদিকে মেরাজের মায়ের বিশ্বাস ছেলের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা গেলে কিছুটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন মেরাজ। মনোয়ারা বেগম বলেন, আমার ছেলেটার চিকিৎসা প্রয়োজন। তার চিকিৎসা হলে দেখবেন অনেকটা ভালো হয়ে যাবে। তখন ওর সামর্থ্য অনুযায়ী ছোটখাটো কাজে যুক্ত করে দেওয়াটা সম্ভব হবে। আমার নিজের কোনো সামান্য না থাকায় চিকিৎসা করাতে পারিনি। এখন কেউ যদি আমার ছেলেটার দায়িত্ব নেন, তাহলে আমি মরে গিয়ে একটু শান্তি পেতাম।
রংপুর সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহাজাদা আরমান বলেন, আমি পরিবারটি খোঁজ নিয়েছি। এরআগেও নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করেছি। এখন সিটি কর্পোরেশন থেকে তাকে (মেরাজ) সহযোগিতা করার জন্য চেষ্টা করছি। তবে শুধু দু-একজনের সহযোগিতায় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেরাজ হোসেনের চিকিৎসা করা সম্ভব হয়ে উঠবে না। সমাজের বিত্তবান ও হৃদয়বান মানুষেরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে অসহায় ওই মায়ের মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব হবে।
রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন জানান, প্রতিবন্ধী ভাতা কার্যক্রমের আওতাভুক্ত রয়েছে মেরাজ। তাকে নিয়মিত প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান করা হয়। তবে তার চিকিৎসা সহায়তার জন্য পরিবার থেকে কেউ কোনো আবেদন করেনি।
মেরাজ হোসেনকে সাহায্য পাঠাতে বা তার পরিবার সম্পর্কে আরও জানতে চাইলে তার মা মনোয়ারা বেগমের ০১৭৯৩৩৮০৭৬১ (বিকাশ) নম্বরে যোগাযোগ করা যাবে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে