পুলিশের সংকেত অমান্য করে পালিয়ে যাচ্ছিল একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। দ্রুত সেই খবর পৌঁছে যায় সামনের চেকপোস্টে। পরের চেকপোস্টে পৌঁছামাত্রই দায়িত্বরত সার্জেন্ট হাত দিয়ে ধরে আটকানোর চেষ্টা করেন ইজিবাইকটিকে। কিন্তু চালক ছুটছিলেন প্রাণপণে। 

সার্জেন্টকে হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যান প্রায় একশ’ গজ দূরে। পরে সড়ক বিভাজকের বেড়ার ওপর আছড়ে ফেলে পালিয়ে যান। রাস্তায় পড়ে থাকা সার্জেন্ট জ্ঞান হারান। কিন্তু তার দিকে ঘুরেও তাকাননি চালক। 

গত ২ মার্চ রাজশাহী নগরীর রেলগেইট-শিরোইল বাস টার্মিনাল সড়কে এ কাণ্ড ঘটে যায়। এরপর থেকেই দৃশ্যপট থেকে উধাও ওই চালক। আর টানা ৩৫ দিন হাসপাতালে কাটিয়ে কাজে ফেরেন সার্জেন্ট।

ভুক্তভোগী ওই সার্জেন্ট হলেন সন্দীপ মল্লিক। তিনি রাজশাহী মহানগর পুলিশে কর্মরত। অভিযুক্ত চালক মাসুদ রানা (২৭) রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সাব্দিপুর এলাকার মৃত জালাল উদ্দিনের ছেলে। একদিন আগেও তার নাম-পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।

বড়ই অমানবিক এ গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু বৃহস্পতিবার (৮ এপ্রিল) সকাল বেলা শুরু হয় গল্পের নতুন অধ্যায়। সকালে আবারও অটোরিকশা নিয়ে নগরীর রেলগেইট এলাকায় ফেরেন চালক মাসুদ রানা। 

ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় তাকে আটকে দেন দায়িত্বরত সার্জেন্ট সার্জেন্ট রাশেদুল। জব্দ করা হয় সঙ্গে থাকা অটোরিকশার কাগজপত্র। পরে মামলা লিখতে গিয়ে তার চক্ষু চড়কগাছ। নথির সঙ্গে অটোরিকশার নম্বরে মিল নেই। নম্বরপ্লেট থেকে মুছে দেয়া হয়েছে শেষের ডিজিট।

দুয়ে দুয়ে চার। এরপরই মিলে যায় পুরনো হিসাব। ধরা পড়ে যান চালক। কিন্তু তখনও অপরাধ স্বীকার করেননি চালক। এরপর অটোরিকশাটি নেয়া হয় নগর পুলিশের ট্রাফিক শাখার দফরে। সেখানে জেরার মুখে ঘটনার আদ্যপান্ত বলে ফেলেন চালক মাসুদ রানা।

তিনি জানিয়েছেন, তিনি চার ও ছয় বছর বয়সী দুই মেয়ের বাবা। বাবার মৃত্যুর পর বিধবা মাকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু কিছুতেই সংসার চালাতে পারছিলেন না। এরপর ঋণের টাকায় কেনা অটোরিকশা চালিয়ে সংসারের হাল ধরেন। 

সেদিনের ঘটনার অকপট স্বীকাররোক্তি দেন মাসুদ রানা। তিনি জানান, তার অটোরিকশাটি সবুজ রঙের। কিন্তু রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী দুপুর ২টা পর্যন্ত লাল রঙের অটোরিকশা চলাচল করবে নগরীতে। 

গত ২ মার্চ যাত্রী নিয়ে তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে এসেছিলেন। আগের যাত্রীদের নামিয়ে আরো কয়েকজন যাত্রী নিয়ে যান নগরীর রেলগেইট এলাকায়। উদ্দেশ্য ছিল-সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে সোজা গোদাগাড়ী ফিরবেন।

তখন বেলা প্রায় সাড়ে ১১টা। রেলগেইটে ঢুকতেই গাড়ি থামানোর সংকেট দেন একজন সার্জেন্ট। তিনি ভেবেছিলেন, গাড়ি আটকে দেবে। এতে তার সংসার চলবে না। কোনো কিছু না ভেবেই তিনি টান দিয়ে বাস টার্মিনালের দিকে এগিয়ে যান। সেখানে আরেক সার্জেন্ট তাকে আটকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকেও তিনি টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে সড়ক বিভাজকের ওপর ফেলে দেন। 

প্রাণের ভয়ে তিনি সেদিন কোনোরকমে পালিয়ে যান। পরে কয়েকদিন বের হননি রাস্তায়। শেষে বাধ্য হয়ে নম্বর প্লেট থেকে শেষের সংখ্যাটি মুছে দিয়ে গাড়ি আবারও রাস্তায় নামান। 

চালকের ভাষ্য, তিনি বড় ভুল করে ফেলেছেন। এ ভুলের ক্ষমা নেই। তবুও সার্জেন্ট তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তিনি জীবনে আর এমন ভুল করবেন না। রাস্তায় তিনি আইন মেনেই চলাচল করবেন।
 
মনের ক্ষত মুছে গেলেও সেই দিনের শরীরের ক্ষতচিহ্ন আজো মুছে যায়নি সার্জেন্ট সন্দীপ মল্লিকের। এখনো তিনি ঘটনায় আঘাত পাওয়া বাম হাতে শক্তি পান না। তিনি জানান, ধরা পড়ার পর তিনি গিয়ে ওই চালককে শনাক্ত করেছেন। পরে খোঁজ নিয়ে তার পরিবারের দুরাবস্থার কথা জানতে পারেন। পরে মামলার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তিনি। ক্ষমা করে দেন চালককে।

তিনি বলেন, ওই চালক দুই শিশু সন্তানের বাবা। তার নিজেও দুই সন্তান রয়েছে। মামলা হলে তাকে কারাবাস করতে হতো। কিন্তু দুটি সন্তান, আর বিধবা মাকে নিয়ে তার স্ত্রী অনিশ্চতায় পড়তেন। তার পুরো পরিবার ভেসে যেত। বিষয়টি তাকে ভাবনায় ফেলে দেয়। শেষে মামলার সিদ্ধান্ত থেকে তিনি সরে আসেন।

সার্জেন্ট সন্দীপ আরো বলেন, পুলিশ সবসময় আইনের প্রয়োগ করে। অপরাধীদের শাস্তির মুখোমুখি করে অন্যদের শিক্ষা দেয়। এ চালকের ক্ষেত্রেও এমনটি করা যেত। যদিও চালক মানবতা কিংবা সহানুভূতি দেখাননি। কিন্তু তাতেও তার আক্ষেপ নেই। 

সার্জেন্ট সন্দীপ মল্লিকের মানবিকতাকে সম্মান জানিয়েছেন আরএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) অনির্বাণ চাকমা। তিনি বলেন, দুপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তার মনে হয়েছে এটি নিছকই দুর্ঘটনা। পুলিশ দেখে পালাতে গিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন চালক। পরে তাকে মুচলেকা নিয়ে সংশোধনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। পুলিশ চায়, অপরাধের পথ থেকে ফিরিয়ে এনে মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে। 

তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনার পর পুলিশ ওই অটোরিকশাটির নম্বর নিয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছিল। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। পরে বৃহস্পতিবার সেটি আটকা পড়ে। প্রথম দিকে চালক সেদিনের ঘটনা পুরোপুরি অস্বীকার করেন। পরে নিজেই আবার স্বীকার করে নেন। পরে মামলার বিষয়টি ভুক্তভোগী সার্জেন্টের ওপরে ছেড়ে দেয়া হয়। 

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এমএএস