তদন্তে দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এরপরও নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ নিজ পদে বহাল রয়েছেন। প্রকাশ্যে ঘুষ নেওয়া সেই শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এবার বরাদ্দের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। 

সম্প্রতি এক প্রধান শিক্ষক উপজেলা শিক্ষা কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে শিক্ষা কমিটির সভাপতি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা তবিবুল ইসলাম জানান, অভিযোগ তদন্ত করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োজনভিত্তিক খেলার আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য দেড় লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দের অর্থ লোপাট করতে শিক্ষা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে নিম্নমানের মালপত্র ক্রয় করেন। যেখানে ৭০ হাজার টাকার বেশি ব্যয় করা হয়নি। শিক্ষা কমিটির সভায় পরিকল্পনা ও বিল-ভাউচার উপস্থাপন করে বিল প্রদানের নিয়ম থাকলেও তিনি কোনো ধরনের সভা না করে নিজেই বিল প্রদান করে বরাদ্দের মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, উপজেলার ১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলার জিনিসপত্র ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ এসেছে দেড় লাখ টাকা করে। দরপত্র অনুযায়ী কাজের নমুনা দেখে টাকা ছাড় দেবে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তর। কাজ তত্ত্বাবধান করবে উপজেলা প্রকৌশল কার্যালয়।

সরেজমিনে জানা যায়, এসব বিদ্যালয়ে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে নামমাত্র কাজ করে ভুয়া বিল-ভাউচারে বরাদ্দের অর্থ উত্তোলন করেছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এ জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে দিতে হয়েছে বিদ্যালয় প্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নুর মোহাম্মদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে এসব উপকরণ কেনা হয়। প্রতিটি বিদ্যালয়ের জন্য ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের উপকরণ কেনা হয়। তবে বিল-ভাউচারে দেখানো হয় ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।

খেলার জিনিসপত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্ত্বাধিকারী তহিদুল ইসলাম বলেন, ডিমলার ১৮টি বিদ্যালয়ে খেলার উপকরণ সরবরাহ করেছি। প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি করে দোলনা, স্লিপার ও ব্যালেঞ্চার পরিবহনসহ দাম ধরা হয়েছে ৭৬ হাজার টাকা। অন্যান্য খরচ (সিমেন্ট-বালু ও শ্রমিক) বাবদ ধরা হয়েছিল ৩ হাজার।

বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী ও বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, এর আগেও শিক্ষা কর্মকর্তার প্রকাশ্যে ঘুষ গ্রহণের ভিডিও ফাঁস হয়। এরপর থেকে উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর নানা হয়রানির খড়্গ নেমে আসে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও নিজ পদে থেকে দিব্যি দুর্নীতি করে যাচ্ছেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন প্রধান শিক্ষক জানান, নুর মোহাম্মদ বিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও মেরামতের বরাদ্দ থেকে ২০ থেকে ২৫ ভাগ টাকা ঘুষ নেন। বরাদ্দের টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে আটকে রেখে প্রধান শিক্ষকদের খবর দেন টাকা তুলে নেওয়ার জন্য। যেসব বিদ্যালয় ঘুষ দিতে অস্বীকার করে, তাদের টাকা আটকে রাখেন তিনি।

অভিযোগ অস্বীকার করে শিক্ষা কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ বলেন, উপজেলা প্রকৌশল কার্যালয় কাজের মান যাচাই করে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছে। তাই আমিও বরাদ্দের টাকা ছাড় দিয়েছি। তিনি বলেন, ঘুষ না খেলে এখানে কেউ চাকরি করতে পারবে না। কারন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে টাকা দিতে হয়।

এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশল অফিসের সহকারী প্রকৌশলী আব্দুর রহিম বলেন, এস্টিমেট অনুযায়ী কাজের প্রত্যয়ন দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ করে নেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষা অফিসের।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ এম শাহজাহান সিদ্দিকী বলেন, সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষা কর্মকর্তার। কোনো অনিয়ম হলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কর্মকর্তার প্রকাশ্যে ঘুষ গ্রহণের পরও নিজ পদে বহাল থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলেন।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৪ আগস্ট শিক্ষা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদের দরদাম করে ঘুষ নেওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এ ঘটনায় নুর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে স্বপদে বহাল রেখেই তার বেতন গ্রেডের দুই ধাপ নিচে অবনমিতকরণ দণ্ড দেওয়া হয়। গত ২৬ জুন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

শরিফুল ইসলাম/আরকে