ছিন্নমূল মানুষেরা খাবার খাচ্ছেন

শৈশব থেকেই চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় হয়েছেন। অভাবের কাছে হেরে তৃতীয় শ্রেণিতেই ইতি টেনেছেন পড়াশোনার। এরপর কাজ শুরু করেছেন হোটেল বয় হিসেবে। অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করা সেই অভাবী মানুষটি এখন নওগাঁ শহরে দুটি হোটেলের মালিক। তার হোটেলে কর্মসংস্থান হয়েছে আরও ৩৫ জনের।

কিন্তু গরিব-দুঃখী মানুষকে বিনা পয়সায় খাবার খাওয়ানোর জন্য ইতোমধ্যে আজগর হোসেনের হোটেল দুটি ‘গরিবের হোটেল’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। তার এমন উদ্যোগ প্রশংসা কুড়িয়েছে সর্ব মহলে।

নওগাঁ শহরের কোট চত্বরের সামনে হাজীর নজিপুর হোটেল অ্যান্ড বিরিয়ানি হাউজ-১ ও হাজীর নজিপুর হোটেল অ্যান্ড বিরিয়ানি হাউজ-২ নামের খাবার হোটেল দুটির মালিক আলী আজগর হোসেন (৫২)। পাশাপাশি অবস্থিত হোটেল দুটি নওগাঁবাসীর কাছে নজিপুর হোটেল নামে বেশি পরিচিত।

জানা যায়, প্রতি বৃহস্পতিবার দুপুর হলেই বিভিন্ন এলাকা থেকে ছিন্নমূল মানুষেরা এসে এই হোটেলে বসে পড়েন। শতাধিক দরিদ্র, অসহায় ও খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ টেবিলে বসে এক বেলা খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন তারা। দেখে মনে হবে, কোনো আনন্দঘন অনুষ্ঠান। খাবারের জন্য নেই কোনো হুড়োহুড়ি বা কাড়াকাড়ি। যে যখন আসছেন বসে পড়ছেন। এভাবেই চলে দুপুর থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।

যেসব মানুষের ভাগ্যে তিন বেলা ঠিকমতো খাবার জোটে না, তারা প্রতি সপ্তাহে এক বেলা এমন ভালো খাবার পেয়ে খুশি হন। বিনা পয়সায় পেট পুরে খাবার খেয়ে তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফেরেন ছিন্নমূল এসব মানুষ।

সম্প্রতি এক বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে আজগর আলীর হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, হোটেলের ভেতরে ও বাইরে রাস্তার পাশে চেয়ার-টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছেন ৭০ থেকে ৮০ জন নারী-পুরুষ। সবাইকে খেতে দেওয়া হয়েছে। তাদের খাবারের মেন্যুতে ভাতের সঙ্গে ডিম, মাছ, মাংস, ডাল ও সবজি দেওয়া হয়েছে। সবাই তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন। মনে বোঝা যাচ্ছিল, না জানি কত দিনের অভুক্ত তারা।

খাবার খেতে আসা সত্তরোর্ধ্ব সামসুন্নাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলেরা আমার দেখাশোনা করে না। স্বামী মারা যাওয়ার পর ১০ থেকে ১২ বছর ধরে মানুষের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে খাই। ভিক্ষা করে তিন বেলা ঠিকমতো খাবার জোটে না। মাছ-মাংস বছরে একবারও কেনার সামর্থ্য হয় না। আগে তো কোরবানির ঈদে এলে মাংস খাইতাম। কিন্তু এখন প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার এলে আমার কাছে তো ঈদের দিন মনে হয়। এখন প্রতি বৃহস্পতিবার এলে দূরে কোথাও না গিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ভিক্ষা করে দুপুরে নজিপুর হোটেলে এসে কোনো দিন মাংস ও কোনো দিন মাছ দিয়ে পেট ভরে ভাত খাই। খেতে কোনো টাকা লাগে না।

খাবার খেতে আসা প্রতিবন্ধী আব্বাস আলী বলেন, জন্মের পর থেকে আমার দুই পা অচল। কোর্ট এলাকায় বুক ও হাঁটুর ওপর ভর করে ভিক্ষা করে চলি। ভিক্ষার টাকায় কোনোমতে জীবন বাঁচাই। ভালো-মন্দ খাবার আশা করাই তো দোষের। সপ্তাহে এক দিন এখানে আসি একটু ভালো খাবারের আশায়। হাজী সাহেব আমাদের খাওয়ান। এর জন্য কোনো টাকা নেন না। আল্লাহ যেন তার ভালো নসিব করে।

এমন মহতী উদ্যোগের বিষয়ে কথা হয় হোটেল-মালিক আজগর হোসেনের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কোনো প্রচার-প্রচারণার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, নিজের অতীত কষ্টের কথা ভেবে আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় এমন উদ্যোগ। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অভাবী ও দুঃখী মানুষদের মুখে এভাবে এক বেলা খাবার দিয়ে আসছি। আল্লাহ সামর্থ্য দিলে যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিনই এমন মহৎ কাজ করে যেতে চাই আমি।

হোটেল বয় থেকে হোটেল-মালিক হওয়ার গল্প জানতে চাইলে আজগর হোসেন জানান, নাটোরের সিংড়া উপজেলার চক তাতার গ্রামে জন্ম তার। বাবা মানুষের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাতেন। অভাবের সংসারে শৈশব থেকেই চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় হয়েছেন আজগর। সন্তানের মুখে ঠিকমতো খাবার জোগান দিতে না পারায় চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশোনা করা অবস্থায় সাত-আট বছর বয়সে আজগরকে অন্যের বাড়িতে রাখালের কাছ করতে পাঠান তার বাবা-মা। আরও কয়েক বছর পর নওগাঁর আত্রাই উপজেলা সদরে একটি খাবার হোটেলে বয় হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি।

১৯৯৭ সালে আত্রাই থেকে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে নওগাঁয় এসে বসবাস শুরু করেন। নওগাঁয় এসে প্রথমে একটি হোটেলে ২৫ টাকা দিনমজুরিতে থালা-বাসন ধোয়ামোছার কাজ পান। ২০০২ সালের দিকে নওগাঁ শহরের বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যে হোটেলে কাজ করতেন, সেই হোটেলের মালিক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং হোটেল ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

পরে হোটেল-মালিকের সব ঋণ শোধ করে ক্ষুদ্র পুঁজি নিয়ে হোটেল ব্যবসা শুরু করেন আজগর। এরপর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি আর। একটি হোটেল থেকে এখন নওগাঁ শহরে দুটি হোটেলের মালিক তিনি। তার দুই হোটেলে বর্তমানে ৩৫ জন কর্মচারী কাজ করেন।

তিনি আরও বলেন, একেবারে শূন্য থেকে আল্লাহ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। হোটেল ব্যবসা করে নওগাঁ শহরে বাসাবাড়ি করেছি। দুই মেয়ে ও এক ছেলে ভালো স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে। মানুষের দোয়া ও আল্লাহর রহমতে এটা সম্ভব হয়েছে।

আজগর হোসেনের হোটেল ১০ বছর ধরে কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন সোহেল হোসেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, হোটেল-মালিক আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, যেকোনো দিন যেকোনো সময় গরিব, অসহায় ও অর্থহীন মানুষ যদি খেতে চান, তাহলে তাদের আগে খাবার দেওয়ার জন্য। আর আমাদেরও তিনি কোনো দিন কর্মচারীর চোখে দেখেন না বা কারও কাছে কর্মচারী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন না।

শুধু বৃহস্পতিবার নয়, সপ্তাহের সব দিনেই যদি অসহায় মানুষ আসে, তাদের ফিরিয়ে দেন না আজগর। তিনি বলেন, নিয়ত করেছিলাম কখনো যদি অভাব থেকে মুক্ত হতে পারি, তাহলে গরিব-অসহায় মানুষকে খাওয়াব। আর সেই ইচ্ছা থেকে সাধ্যের মধ্যে এক যুগের বেশি সময় ধরে গরিব মানুষকে এক বেলা খাইয়ে আসছি। কারণ, অভাব কী, তা আমি বুঝি। প্রতি বৃহস্পতিবার গরিব-অসহায় মানুষকে খাওয়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য দিনেও যদি কোনো ভিক্ষুক বা অসহায় মানুষ খেতে আসে, আমি তাদের খাওয়াই।

এনএ