পুকুরের পানিতে ভাসছে, ডুবছে বাহারি রঙের মাছ। লাল, কমলা, কালো, বাদামি, হলুদ, রুপালি রঙের মাছের ছড়াছড়ি। শোখিন মানুষরা সাধারণত বাসাবাড়ির অ্যাকোয়ারিয়ামে শোভাবর্ধনে রাখেন এসব মাছ। কিন্তু এসব মাছ এখন চাষ হচ্ছে যশোরে। সালমান সরদার নামের এক তরুণ উদ্যোক্তা শখের বসে শুরু করলেও এখন তা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন তিনি এবং স্বপ্ন দেখছেন এই মাছ রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার।

সালমান সরদার যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা ইউনিয়নের নারাঙ্গালি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নূর মোহাম্মদের ছেলে। সালমান আইন মহাবিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি স্বপ্নিল পরিবার নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত আছেন। বন্ধুদের নিয়ে সেবা দেন প্রতিবন্ধী মানুষকে।

পড়াশোনার পাশাপাশি শখের বশে মাত্র ১ হাজার ৫০০ টাকায় ৬০টি রঙিন মাছ দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। বর্তমানে ২০ বিঘা জমির ১৫টি পুকুরে চাষ হচ্ছে রঙিন মাছ। সৃষ্টি হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান।

জানা যায়, ২০১৮ সালের শুরুতে খুলনা শহরের একটি অ্যাকোয়ারিয়াম ফিশের দোকান থেকে শখের বশে দেড় হাজার টাকা দিয়ে ৬০ পিস রঙিন মাছ কিনে আনেন। তখন মাছের নামও জানতেন না তিনি। পরে জানতে পারেন, সেগুলো গোল্ড ফিশ ও কমেট প্রজাতির ছিল। গ্রামের বাড়িতে ধান সেদ্ধ করার হাউসে রেখে দেন তিনি। ছয় মাস পর পানি পরিবর্তন করার সময় কয়েকটি মাছের পেটে ডিম দেখতে পান। এ সময় অসাবধানতাবশত পাঁচটি মাছ মারা যায়। পানি পরিবর্তনের পর দেখতে পান, সেগুলো ডিম ছেড়েছে। বুঝলেন পানি পরিবর্তন করা হলে এগুলো ডিম পাড়ে। এরপর তিনি পুরোদমে চাষ করছেন এসব রঙিন মাছের।

ঢাকা পোস্টের কাছে সফলতার গল্প তুলে ধরে সালমান বলেন, বর্তমানে ১৫টি পুকুরে প্রায় কোটি টাকার মূল্যের ৫২ প্রজাতির রঙিন মাছ রয়েছে আমার। প্রথমে নিজেদের পুকুরেও চাষ শুরু করলেও এখন আশপাশের কিছু পুকুর ভাড়া নিয়ে চাষ করছি। এখানে লাল, কমলা, কালো, বাদামি, হলুদ, রুপালি রঙের মাছ আছে। এখানে দেখা পাওয়া যাবে গোল্ড ফিশ, কমেট, কই কার্প, মিল্কি, সিল্কি, ব্লাক মোর, রেডকার্প, মলি, গাপ্পি, বাটারফ্লাই, গোরামি, ফাইটার, অ্যাঞ্জেল প্রভৃতি বর্ণিল মাছের। যা দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যাবে সবার।

তিনি বলেন, আমার সময় কাটে মাছের সঙ্গে। খাবার দেওয়া ও পানি সরবরাহ করি নিজেই। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমার মাছ চাষের খবর জানাজানি হয়। তখন আমার গ্রামের পাশেই ফুলের রাজ্য গদখালিতে বেড়াতে আসা মানুষ আমার মাছের খামারও দেখতে আসেন।

সালমানের এই উদ্যোগের ফলে তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে অর্ধশতাধিক লোক কাজ করছেন। যা তাদের ভাগ্য খুলে দিয়েছে। এ ছাড়া কিছু শিক্ষার্থী রয়েছে, তারা পার্টটাইম কাজ করে। করোনাকালে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় তারা এখানে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। মজুরির সঙ্গে উপরি হিসেবে পাচ্ছে প্রশিক্ষণ। এ ছাড়া কাজ করেন কয়েকজন পেশাদার জেলে। সপ্তাহে তিন-চার দিন তারা জাল টানেন।

সালমানকে দেখে এরই মধ্যে শতাধিক নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। তবে তিনি অভিযোগ করেন, তার এই মাছের খামারে মৎস্য কর্মকর্তাদের তেমন সহযোগিতা পাননি তিনি। বিভিন্ন সময়ে মাছের সাধারণত পাখনা ও ফুলকা পচা রোগ হয় আর উঁকুনের আঘাতে ক্ষত তৈরি হয়। সেগুলো নিজ অভিজ্ঞতায় পরিমাণমতো লবণ, পটাশ, ফিটকিরি আর চুন ব্যবহার করে চিকিৎসা দিয়ে আসছেন তিনি। সালমান সরকারি সহযোগিতা পেলে বিদেশে পাঠাতে চান এসব মাছ। তবে বিভিন্ন জেলায় মাছ পরিবহনে রয়েছে নানা সমস্যা বলে জানান তিনি।

খামারে কাজ করা সবুজ নামের একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার কলেজ বন্ধ। তাই সালমান ভাইয়ের মাছের খামার দেখাশোনা করছি। সেই সঙ্গে কীভাবে রঙিন মাছ চাষ করতে হয়, সেটাও হাতে-কলমে শিখেয়ে দেয়। আমার মতো অনেকেই একই উদ্দেশ্যে মাছ চাষ শিখছে। লোকজন প্রায় প্রতিদিনই মাছের খামার দেখতে আসে। সেই সঙ্গে পরামর্শ ও মাছ কিনে নিয়ে যায় তারা।

ছেলেকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে পেরে খুশি সালমানের বাবা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নূর মোহাম্মদ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি চান বেকার যুবকরা যেন তার ছেলের মতো আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়। তিনি আরও বলেন, সালমানের খামারে এখন অর্ধশতাধিক শ্রমিক কাজ করছেন। এতে তাদের পরিবারে আয়ের সংস্থানের সুযোগ হয়েছে। সালমান এখন সফল অর্নামেন্টাল ফিশ বা বাহারি রঙের মাছচাষি। দেড় হাজার টাকা দিয়ে মাছ চাষ শুরু করে গেল কয়েক বছরে কম করে হলেও ৭০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেছে সালমান। আর এ বছর এক কোটি মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে সে বলে জানান সালমানের বাবা।

এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, পুরোপুরি আমদানিনির্ভর এ খাতের অর্ধেকের বেশি চাহিদা পূরণ করছেন সালমানের মতো তরুণরা। বিদেশেও এর বেশ চাহিদা রয়েছে। মাছ চাষে আগ্রহ বাড়াতে উদ্যোক্তাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছেও বলে জানান এই কর্মকর্তা।

এনএ