করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফনকাজ সম্পন্ন করছেন ফাহাদ

ঘড়ির কাঁটা রাত তখন সাড়ে ১২টার ঘরে। হঠাৎ ফাহাদ বিন বেলায়েতের মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক পরিচিত নারীর কল। ধরতেই ওই নারীর মেয়ে বলে ওঠেন, ‘ভাইয়া, আম্মুর করোনা পজিটিভ, এখন অবস্থা খুব খারাপ। দ্রুত একটু আমাদের বাসায় আসেন।’ ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও এ কথা শুনেই রাত ১টায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো তিনি ওই বাসায় ছুটে গেলেন।

তবে ফাহাদ কোনো চিকিৎসক নন, একজন স্বেচ্ছাসেবক। চিকিৎসকদের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি শুধু ওই রোগীকে সেবা নেওয়ার পরামর্শ দেন।

গত ৭ এপ্রিল রাতে এমন একটি কল পেয়ে ফাহাদ লক্ষ্মীপুর শহরের ল ইয়ার্স কলোনির করোনায় আক্রান্ত রোগীর বাসায় যান। এর আগে আক্রান্ত রোগীর বাসায় ওষুধ পৌঁছে দেওয়াসহ সেবনের নির্দেশনা দিয়ে আসেন। রাতে অবস্থার অবনতি দেখে আক্রান্ত রোগীর মেয়ে ও নাতনি ভয় পেয়ে ফাহাদকে জানান। পরিবারকে সাহস ও ভরসা দিতে পুরোটা রাত ফাহাদ সেখানেই অবস্থান করেন।

সবশেষ শুক্রবার (৯ এপ্রিল) রাতে সদর হাসপাতালে এক রোগীর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। এ খবর পেয়ে চিকৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ নিয়ে ফাহাদ সদর হাসপাতালে ছুটে যান। বলতে গেলে করোনাকালীন এক অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেছেন ফাহাদ বিন বেলায়েত।

এদিকে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবার লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য একটি মানবিক পোস্ট করেন ফাহাদ। পরে এক নারী ফাহাদের সংগঠনের জন্য একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার উপহার দিয়েছেন।

জানা গেছে, করোনায় আক্রান্ত রোগী সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা হারুনুর রশিদকে সেবা দিতে গত বছরের জুন মাসে ফাহাদ ১৫ দিন অবস্থান করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই রোগী আর বাঁচেননি। ব্যাংক কর্মকর্তার দুই ছেলেও করোনা পজিটিভ হন।

আরও জানা যায়, এ পর্যন্ত ফাহাদসহ তার দল ২৪ জনের মরদেহ দাফন করে। এর মধ্যে ২১ জন করোনা পজিটিভ ও ৩ জন উপসর্গে মৃত্যুবরণ করেন। মহামারি করোনার ভয়াবহতায় মৃত ব্যক্তি বাবা-ভাই-ছেলেসহ আত্মীয়দের পরিবর্তে এগিয়ে আসেন ফাহাদের মতো স্বেচ্ছাসেবীরা।

ফাহাদ বিন বেলায়েতে

লক্ষ্মীপুরে মেঘ ফাউন্ডেশনের নেতৃত্ব দেন ফাহাদ। স্বেচ্ছাসেবী এ সংগঠনকে তিনি মানবিকতার শিকড় হিসেবে রূপ দিয়েছেন। তিনি ভাষার প্রদীপের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯ এপ্রিল এ সংগঠনটির ১৩ বছর পূর্ণ হবে। সংগঠনটির প্রথম আকর্ষণ ছিল কেউ বাংলায় মোবাইল নম্বর বলতে পারলেই ফ্লেক্সিলোড পুরস্কার পেতেন। ফাহাদ নিজেই পুরস্কার দিতেন।

পরবর্তীতে মা ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা নিয়ে ফাহাদ চালু করেছেন ‘মায়ের ভাষায় মাকে চিঠি লিখি’ প্রতিযোগিতা। তার এ অভিনব আয়োজন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়। এতে ১৩টি দেশের শিক্ষার্থীরা তাদের মাতৃভাষায় চিঠি লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আর ফাহাদ প্রতিবছরই ভিন্নধর্মী আয়োজন দিয়ে এ প্রতিযোগিতাকে আকর্ষণীয় করে তোলেন।

এবার তিনজন ভিক্ষুক মাকে প্রধান অতিথি করে প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন ফাহাদ। করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে এবার অনলাইনে এ প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে ভিক্ষুক মায়েদের মধ্যে একজনকে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সেলাই মেশিন দেওয়ার কথা রয়েছে।

ফাহাদ লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড মেঘনা সড়কের বাঞ্চানগর এলাকার মৃত বেলায়েত হোসেন রিপনের ছেলে। বর্তমানে মা ও ভাইকে নিয়ে তার সংসার। তিনি ব্যক্তিগতভাবে একজন ফ্রিল্যান্সার। যার উপার্জন দিয়ে সংসারের পাশাপাশি মানবিক কাজে ব্যয় করেন। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে তিনি ইতিমধ্যে ‘জয় বাংলা ইউথ অ্যাওয়ার্ড সম্মাননা-২০২০ ও বঙ্গবন্ধু সোশ্যাল ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড-২০২০’-এ দুটি সম্মাননা অর্জন করেন।

জানতে চাইলে ফাহাদ বিন বেলায়েত ঢাকা পোস্টকে বলেন, সামাজিক সংগঠনের কাজ আমার রুটিরুজির স্থান নয়। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। আমার ঘরে আমার মা-ভাই-আত্মীয়স্বজন করোনায় আক্রান্ত হলেও আমি যে দায়িত্ব পালন করতাম, তা এখন অন্যদের জন্য করি। আমি যেহেতু একজন স্বেচ্ছাসেবী, সেহেতু আমার কাজ হচ্ছে সুখ-দুঃখে মানুষের পাশে থাকা। নিজে যতটুকু পারি, তা দিয়েই অন্যের সেবায় কাজ করে যাচ্ছি। আমার বা আমাদের উদ্যোগ দেখে অনেকেই অসহায়দের জন্য আমাদের মাধ্যমে সহযোগিতা করেন। যারা তাদের পরিচয় জনসমক্ষে আনতে চান না।

এনএ