কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলা। জেলা সদর থেকে চার উপজেলা অতিক্রম করে সড়কপথে যেতে হয় মনোহরগঞ্জ। যেখানে ডাকাতিয়া নদী ও ঘাগরিয়া নদীর মোহনা। শহর থেকে ৪৬ কিলোমিটার যাওয়ার পর কুমিল্লার শেষ উপজেলা মনোহরগঞ্জ। উপজেলা সদর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে মানরা গ্রাম। ডাকাতিয়া নদীবেষ্টিত নিভৃতপল্লি গ্রামটি উপজেলার হাসনাবাদ ইউনিয়নের অন্তর্গত।

হাসনাবাদ ইউনিয়নের মানরা গ্রামের দুই কৃতী সন্তান আরিফ হোসেন ও শরিফ হোসেন। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন যমজ ভাই আরিফ-শরিফ। আরিফ হোসেন জাতীয় মেধায় ৮২২তম হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও শরিফ হোসেন ১১৮৬তম হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।

আরিফ-শরিফের বাবা বিল্লাল হোসেন পেশায় একজন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক। মা নাছরিন বেগম গৃহিণী। বিয়ের পর ১১ বছর নিঃসন্তান ছিলেন বিল্লাল-নাছরিন দম্পতি। এ নিয়ে সংসারে ছিল অশান্তি। যখন সবারই মন খারাপ, সে সময় ঘর আলোকিত করে জন্ম নিলেন আরিফ হোসেন ও শরিফ হোসেন।

জানা যায়, পাঁচ বছর বয়সে তাদের মা-বাবা তাদের লেখাপড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। ভর্তি করা হয় গ্রামের একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে। কিন্তু অর্থসংকটে এই স্কুলে বেশি দিন পড়াতে পারেননি। এক বছর পর দুই সহোদরকে ভর্তি করা হয় পাশের গ্রাম আশিয়াদারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শুরু থেকেই পড়ার প্রতি দুজনের মনোযোগ ছিল নজরকাড়া। আরিফের রোল এক, শরিফের রোল দুই অথবা তিন। এ ধারা চলেছিল একটানা দশম শ্রেণি পর্যন্ত।

চতুর্থ শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় আরিফ হোসেন অংশ নেন বিতর্ক প্রতিযোগিতায়। কুমিল্লা জেলা শহরের নামিদামি স্কুলকে হারিয়ে শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক হন অজপাড়াগাঁয়ের আরিফ হোসেন। শিশু বয়সে যুক্তি খণ্ডন করেন বিভাগীয় পর্যায়ে। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান আরিফ হোসেন। আশিয়াদারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ (গোল্ডেন) পেয়ে উত্তীর্ণ হন দুই ভাই।

দুই ভাইয়ের বিষয়ে আশিয়াদারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ছালে আহম্মদের সঙ্গে ঢাকা পোস্টের কথা হলে ভালোবাসা আর আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে তিনি এই কথাগুলো বলেন।

প্রধান শিক্ষক বলেন, বিভাগীয় পর্যায়ে যখন আরিফ বিতর্কে অংশ নেবে, আমি তাকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামে যাই। আমার কোনো শিক্ষার্থীর কোনো অর্জনে আমি পুলকিত হই। ছাত্রছাত্রীদের ছাড়া আমার ভালো লাগে না, সময়ও কাটে না। করোনায় স্কুল বন্ধ ছিল, কিন্তু প্রতিদিন স্কুলে আসি। আঙিনা পরিষ্কার রাখি। ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি গিয়ে খবর নিই। তাদের বলি, করোনার কারণে তোমরা লেখাপড়া বন্ধ কোরো না। ঘরে বসে বসেই পড়ো।

নিজ বাড়িতে স্বজনদের সঙ্গে আরিফ-শরিফ

এরপর নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের মান্দারগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ে। সেখানে থাকতেন স্কুল ছাত্রবাসে। এ স্কুলের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক ও ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক শ্রী দিলিপ কুমার শীল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আরিফ-শরিফকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাদের বাবা প্রতিদিন সকাল-বিকেল অটোরিকশা চালিয়ে এসে তাদের ভাত দিয়ে যেতেন। দুই ভাই শুধু পড়াশোনা নিয়ে থাকত।

তিনি আরও বলেন, টিফিন সময়েও ক্লাস রুমে বসে বসে পড়ত। ছাত্রাবাসেও শুধু পড়ালেখা, খাওয়া, ঘুম। কখনো তাদের দেখিনি বাজারে হাঁটাচলা করতে বা অন্য কোনো খারাপ কাজে জড়িত হতে। তখনই আমাদের মনে হয়েছে, তারা একদিন ভালো কিছু করবে। তারা আজ আমাদের স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটিয়েছে।

শিক্ষার দ্বিতীয় ধাপ পার হতে দুই সহোদর উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন কুমিল্লা সরকারি সিটি কলেজে। দুই ভাইয়ের প্রিয় শিক্ষক রসায়নের সহকারী অধ্যাপক ড. মু. কাজী শাহনূর আলম ও আবুল হোসেন। ঢাকা পোস্টের কথা হয় কাজী শাহনূর আলমের সঙ্গে। জীবনে বড় হওয়ার জন্য দারিদ্র্য থাকতে হয়। আমাদের আরিফ-শরিফ ভালো চিকিৎসক হবে। ভালো মানুষ হবে, এমন প্রত্যাশা করে তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘দারিদ্র্য’ কবিতা উদ্ধৃত করে বলেন, ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান। তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।’

আরিফ ও শরিফ মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ায় প্রধান শিক্ষক ও কমিটির সদস্যরা দুই ভাইয়ের বেতন মওকুফ করে দিয়েছেন। পরে মাধ্যমিক পরীক্ষায় আরিফ হোসেন জিপিএ-৫ (গোল্ডেন) ও শরিফ হোসেন জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

স্থানীয় হাসনাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কামাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আরিফ হোসেন ও শরিফ হোসেন আমাদের এলাকার কৃতী সন্তান। তাদের বাবা অটোরিকশাচালক। তবু তারা সংগ্রাম করে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সাফল্যে আমরা আনন্দিত। অদম্য মেধাবী দুই ভাইয়ের পড়াশোনার বিষয়ে সবার সহযোগিতা কামনা করছি।

মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, তাদের সংগ্রামী বাবাকে আমরা অভিবাদন জানাই। তিনি তার সন্তানদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছেন। ইতোমধ্যে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক তার সন্তানদের ভর্তির জন্য আর্থিক অনুদান প্রদান করেছেন। তাদের শিক্ষাবিষয়ক যেকোনো প্রয়োজনে আমরা সঙ্গে আছি।

দীর্ঘ সংগ্রাম আর সংকটের কথা শুনতে ঢাকা পোস্টের কথা হয় আরিফ-শরিফের বাবা বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে তিনি বলেন, যমজ দুই ছেলের পড়ালেখার খরচ। তৃতীয় ছেলে মাদরাসায় হিফজ পড়ে। তার হোস্টেল খরচ। ছোট মেয়ে স্কুলে পড়ে। তার বেতন। বৃদ্ধ মা-বাবার ওষুধ-চিকিৎসা ব্যয়সহ পরিবারের আট সদস্যের ভরণপোষণের আমি একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অভাবের কারণে নিজে পড়তে পারিনি। তাই আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন সন্তানরা মানুষ হয়।

আরিফ-শরিফ চিকিৎসক হলে আমি সম্পদের মালিক হব, সে আশা আমার নাই, এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, এখন খরচ বেড়েছে। এ সময়ে তাদের পেছনে লেখাপড়ার জোগান দেওয়া আমার জন্য কঠিন। দেশের, সমাজের মানুষের কাছে আকুল আবেদন, তারা যেন আমার সন্তানদের পড়ার পথ সুগম করে দেয়। সপ্তাহে আমার দুটি কিস্তি। একটি রিকশা কিনেছি কিস্তিতে। ঋণ করে ঘর তৈরি করেছি। আমি সবার দোয়া ও সহযোগিতা চাই।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের পক্ষে এক লাখ টাকা অনুদান তুলে দিচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা

দুই যমজ সন্তানের সাফল্যে খুশিতে কাঁদছেন মা নাছরিন বেগম। স্মৃতিচারণার একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নাছরিন। আমরা নিঃসন্তান ছিলাম। তাই মানুষ নানা কথা বলত। ১১ বছর মানুষের কথা সহ্য করেছি। স্বামী যখন কারাগারে ছিলেন, লোকে বলেছে, তুই বাবার বাড়ি চলে যা। তোর স্বামী আর ফিরবে না, ছেলেমেয়েও নাই। কারও কথার প্রতিবাদ করিনি। আল্লাহর কাছে শুধু চেয়েছি। ১১ বছর পর দুটি সোনার টুকরা আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় পাসের খবর নিয়ে, দুই ছেলে আমকে জড়িয়ে ধরে উঠানে কান্না শুরু করেছে। আমি তাদের চোখের পানি মুছে ঘরে নিয়ে আসি।

নাছরিন বেগম বলেন, আমি আল্লাহর দরবারে শোকর করি। আল্লাহ তুমি আমার মনের আশা পূরণ করেছ। সন্তানদের পড়ার ক্ষতি হবে, তাই আমি ৬-৭ মাসেও বাবার বাড়ি যাইনি। আমি বেড়াতে গেলে তাদের স্কুল মিস হবে। এমনও মাস গেছে আমি বাজার থেকে এক কেজি তরকারি কিনে খাইনি। শাক-লতাপাতা রান্না করে দিনাতিপাত করেছি। এমনও কঠিন সময় গেছে এক কেজি চাল কিনে রান্না করে ঘরের সবাইকে নিয়ে খেয়েছি। তবু ছেলেদের পড়ালেখা বন্ধ করিনি। অভাবের তাড়নায় কোনো কাজে দিইনি ছেলেদের। দোয়া করি, আরিফ-শরিফ যেন মানুষের মতো মানুষ হয়। তারা দেশ ও মানুষের উপকার করে।

ঢাকা পোস্টকে আরিফ হোসেন ও শরিফ হোসেন বলেন, আমরা দারিদ্রের কশাঘাতে বড় হয়েছি। মানুষের কষ্ট বুঝি। ভালো চিকিৎসক হতে চাই। মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চাই। দেশের সংকটে, মানুষের বিপদে যেন কাজ করতে পারি, সে জন্য সবার দোয়া চাই।

প্রসঙ্গত, গত ৪ এপ্রিল স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর আনুষ্ঠানিকভাবে মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ৪৮ হাজার ৯৭৫ জন শিক্ষার্থী। পাসের হার ৩৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

এনএ