রংপুর নগরীর যানজট নিরসনে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে সিটি বাস সার্ভিস চালুর ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও চার্জাররিকশা মালিক-শ্রমিকদের আন্দোলনের তোপের মুখে পুলিশ কমিশনারের ঘোষণা ভেস্তে গেছে। এতে করে নগরীর প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব সড়কে এখনো আগের মতোই ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জাররিকশা গিজ গিজ করছে। দুর্ঘটনাপ্রবণ ও বিপজ্জনক এসব হালকা যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং যানজট নিরসনে এবার নতুন উদ্যোগ নিয়েছে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরপিএমপি)।

জানা গেছে, বৈধ-অবৈধ মিলে রংপুর নগরীতে ৪০ হাজারের বেশি ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জাররিকশা চলাচল করছে। অথচ সিটি করপোরেশন থেকে সড়ক নেটওয়ার্ক বেহাল দশায় থাকায় সীমিত সংখ্যক পরিবহনের নিবন্ধন (লাইসেন্স) দেওয়া রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অনিবন্ধিত ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জাররিকশার লাগাম টেনে ধরতে এবার নিবন্ধিত অটোরিকশা নীল রং করা হচ্ছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে বৈধ-অবৈধ যানবাহন দ্রুত শনাক্ত করতে পারবে পুলিশ।

বর্তমানে ব্যাটারিচালিত নিবন্ধিত অটোরিকশা (থ্রি হুইলার) নীল রং করার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এরপর পুলিশ বৈধ-অবৈধ অটোরিকশা শনাক্তকরণ এবং অনিবন্ধিত অটো ও চার্জাররিকশা চলাচল বন্ধে অভিযান শুরু করবে। নগরীতে বাইরের অটোরিকশার প্রবেশ বন্ধ করা গেলে যানজট কমার সঙ্গে জনমনে স্বস্তিও ফিরবে। এদিকে পুলিশের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তবে অহেতুক হয়রানি বন্ধ করাসহ সঠিক প্রক্রিয়ায় যানজট নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকে দায়িত্বশীল হবার আহ্বান জানিয়েছে মালিক ও শ্রমিকরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, সপ্তাহখানেক ধরে নগরীর কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে নীল রংয়ে রাঙানো হচ্ছে বৈধ অটোরিকশাগুলো। অটো’র বৈধ কাগজপত্র দেখে রং করাচ্ছেন এবং রং করানো শেষে অটোগুলো পুনরায় কাগজপত্র দেখে চালকের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বৈধ যানবাহনগুলোকে রঙ ও ডিজিটাল ডিভাইসের আওতায় আনা হচ্ছে। এতে বাড়তি খরচ হলেও খুশি ইজিবাইক মালিকরা। আর এসব দেখভাল করছেন অটোমালিক, শ্রমিক ও সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি এবং মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। ইতোমধ্যে নীল রঙ করা নিবন্ধিত অটোরিকশাগুলো সড়কে চলাচল শুরু করেছে।

এদিকে নির্ধারিত সময়ের সকল নিবন্ধিত অটোরিকশাগুলো নীল রংয়ের আওতায় আনতে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে সিটি কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ। কেউ যদি নীল রং না করে সড়কে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়ে নগরীতে মাইকিং করা হয়েছে। নিবন্ধিত অটো নীল রঙ হয়ে গেলে সহজেই বৈধ অবৈধ অটো চিহ্নিত করা যাবে। এতে করে নগরীতে বাড়তি অটোরিকশার চাপ ও যানজট যেমন কমবে অন্যদিকে নগরের সড়কে শোভা পাবে দৃষ্টিনন্দন গণপরিবহন।

কালেক্টরেট মাঠে অটোরিকশা রং করাতে আসা নগরীর শাপলা চত্বর এলাকার অটোরিকশাচালক লাবলু মিয়া বলেন, আমাদের শহরে একটি অটোরিকশার লাইসেন্স দিয়ে তিন থেকে চারটি গাড়ি চলে। একজন অটোরিকশা চালিয়ে তার নম্বরপ্লেট নিবন্ধনহীন অটোরিকশাতে লাগায়। এতে করে সার্বক্ষণিক নগরীতে অটোরিকশার চাপ থাকে। এছাড়া বাইরের অনিবন্ধিত অটোরিকশা এসে শহরে যানজট বাড়িয়ে দেয়। পুলিশ যে পদ্ধতিতে যানজট নিরসন করার পাশাপাশি অবৈধ অটোরিকশা শনাক্ত করতে চায়, আমাদের তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এর আগেও দুই দফায় লাল ও হলুদ করে বৈধ অটোরিকশা শনাক্ত করা হয়েছিল। এর সুফল বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।

আলমনগর বাবুপাড়া এলাকার অটোচালক মকবুল হোসেন বলেন, লাইসেন্স ছাড়া অটোরিকশাগুলো সকালে নগরীতে ঢুকে পড়ে। পরে শহরের নিবন্ধিত অটোরিকশা চলাচল শুরু করলে যানজট লেগে যায়। এতে করে আমরা যে রাস্তায় তিনবার যাতায়াত করতাম সেখানে এখন একবার যাতায়াত করতে পারছি। আমাদের আয় কম হচ্ছে। যাত্রীরা অস্বস্তিতে যাতায়াত করছে। অটোরিকশাগুলো রং করার পর নগরীর আটটি প্রবেশমুখে চেকপোস্ট বসিয়ে নিবন্ধনহীন অটোরিকশা বন্ধ করলে এর সুফল তারা পাবেন বলে তিনি মনে করেন।

আরেক চালক আলতাব হোসেন বলেন, রং করার জন্য ৪০০ টাকা করে নিচ্ছে। আপাতত ৪০০ টাকা অনেক বেশি মনে হচ্ছে। তবে এর যে সুবিধা পাওয়া যাবে তা ৪০০ টাকার চার গুণ হবে। আমাদের অটোরিকশার পাশাপাশি লাইসেন্স থাকা চার্জাররিকশাকেও রং করতে হবে। তা না হলে নগরীতে যানজট কমবে না। নগরীতে অবৈধ অটোরিকশা চলাচল করলে তা ডাম্পিং করতে পুলিশকে আরো কঠোর হতে হবে।

রংপুর সিটি করপোরেশন বলছে, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও রিকশার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে ৮ হাজার। এর মধ্যে অটোরিকশা ৫ হাজার এবং ব্যাটারিচালিত রিকশা ৩ হাজার। কিন্তু বাস্তবে সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার। ২৫ হাজার নিবন্ধনহীন অটোরিকশা রয়েছে নগরীতে।  প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি এখন ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জাররিকশার অবাধ চলাচলে সুবিধার পরিবর্তে দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষের। বিশেষ করে নগরীর ধাপ মেডিকেল মোড়, চেকপোস্ট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক মোড়, ডিসির মোড় হয়ে সিটি বাজার, জাহাজ কোম্পানি মোড় থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত যানজট দেখা দিচ্ছে।

এদিকে যানজট নিরসনে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিনিয়ত সড়কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। কখনও রোড ডিভাইডার, কখনও এক পথ বন্ধ, অন্য পথ খোলা, ঈদের আগে টাউন হল থেকে জাহাজ কোম্পানি মোড় পর্যন্ত অটোপ্রবেশে নিষেধাজ্ঞা। নানা রকম কৌশল ও উদ্যোগ নিলেও কোনো সুফল বয়ে আনেনি।

সবশেষ প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মোড়ে ডিজিটাল ট্রাফিক সিগন্যাল সিস্টেম স্থাপন করা হয়। এই ডিজিটাল ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু করা হলেও যানজট নিয়ন্ত্রণে বিন্দুমাত্র প্রভাব পরেনি। শৃঙ্খলা তো দূরের কথা, উল্টো ডিজিটাল সিগন্যাল সিস্টেম বুঝতে না পারায় ইচ্ছেমতো চলছে এসব যানবাহন। প্রতিদিন সকালে মিঠাপুকুর, পীরগাছা, কাউনিয়া, গঙ্গাচড়া, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জসহ রংপুর সদরের বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে নিবন্ধনহীন অটোরিকশা ও চার্জাররিকশা নগরীতে প্রবেশ করছে। ফলে তীব্র যানজট হচ্ছে।

অটোশ্রমিক সোসাইটি রংপুর মহানগর শাখার সভাপতি নুরুল হক জানিয়েছেন, সিটি করপোরেশন থেকে নিবন্ধিত অটোরিকশাগুলো সব নীল রং করা হচ্ছে। প্রথমদিকে এই কাজে অনীহা থাকলেও প্রতিদিন রং করা অটোর সংখ্যা বাড়ছে। এরইমধ্যে ২ হাজারের বেশি অটোরিকশা রং করা হয়েছে। বাকিগুলো রং করতে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এসব বৈধ অটোরিকশা সড়কে চলাচল শুরু করলে বাইরের অটোরিকশা আর নগরীতে সহজে প্রবেশ করবে না, একই সঙ্গে অবৈধ অটোরিকশাও চলবে না।

তবে অনেকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এর আগেও সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে অটোরিকশাগুলোকে দুই দফায় হলুদ ও লাল রং করা হয়েছিল। পরে সেই উদ্যোগ আলোর মুখে দেখেনি। এবার সিটি করপোরেশন ও পুলিশ যৌথভাবে উদ্যোগ নেয়ায় যানজট নিয়ন্ত্রণ ও অনিবন্ধিত অটোরিকশা ও চার্জাররিকশার চলাচল বন্ধ করার সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সচেতনমহল।

রংপুর মহানগর সুজনের সভাপতি খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, ব্যাটারিচালিত  নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত অটোরিকশা এবং চার্জাররিকশার কারণে নগরীতে চলাচল করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েকবার ঘটা করে সিটি বাস সার্ভিস চালুর জন্য সিটি করপোরেশন থেকে কখনো মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এবার রঙ করার মাধ্যমে যানজট কমানোসহ বৈধ-অবৈধ অটোরিকশা ও চার্জাররিকশার দৌরত্ব থামানোর এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন হলে নগরীতে আমরা স্বস্তিতে চলাচল করতে পারব।

এদিকে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মেনহাজুল আলম বলেন, সবাই মিলে অবৈধ যান ঠেকানোসহ যানজট নিরসনে নীল রঙের অটো চলাচলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিটি করপোরেশন থেকে কোড নাম্বার দেওয়া হবে। সব অটোরিকশা নীল রং হলে সহজে বৈধ-অবৈধ বোঝা যাবে। এতে যানজট কমবে।

রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জানিয়েছেন, সহজ যোগাযোগ স্থাপন, আধুনিক নগরায়ন গড়াসহ যানজটমুক্ত নগর উপহারে যেকোনো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুতি আছে তার পরিষদ। সবার মতামত নিয়ে পরিকল্পিত এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে ৭০ শতাংশ যানজট কমবে নগরে কমবে বলে দাবি করেন তিনি। এর পরেও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায় কিংবা পেশিশক্তির দাপটে নগরীতে অবৈধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করলে শক্ত ব্যবস্থা নেয়ারও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

সম্প্রতি আরপিএমপি কমিশনার নগরীতে সিটি বাস চালুর সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানান। এ সিদ্ধান্ত জানাজানি হলে সিটি বাস সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত বাতিলসহ ৯ দফা দাবি আদায়ে অনশনে বসে ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জাররিকশার চালক ও মালিকরা। তাদের আন্দোলনের মুখে সিটি বাস সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত থমকে যায়। পরে অটোরিকশা শ্রমিক-মালিক, পুলিশ ও সিটি কর্তৃপক্ষ যৌথ সভায় বৈধ অটোরিকশা নীল রঙ করে চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরপিএমপি) কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, যানজট রংপুর নগরীর অন্যতম একটি সমস্যা। সমস্যা সমাধানে আমরা ডিজিটাল ট্রাফিক সিগন্যাল সিস্টেম চালু, যান চলাচলে বিকল্প সড়কের ব্যবহার, নিবন্ধিত অটোরিকশা রং করে চিহ্নিত করা, সড়কের কার্যকর ব্যবহার, পার্কিংয়ের স্থান নির্ধারণ করাসহ নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছি। এখন যানজট নিরসনে জনপ্রতিনিধি, শ্রমিক-মালিক সংগঠন, ব্যবসায়ীসহ নগরবাসীর সহযোগিতা প্রয়োজন।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে