যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি ইউনিয়নের বোধখানা মহিলা দাখিল মাদরাসায় কয়েক বছর ধরে শিক্ষক সংকট চলছে। বাধ্য হয়ে টানা ১০ মাস নিরাপত্তাকর্মীকে দিয়ে ক্লাস নিয়েছেন মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের দাবি এনটিআরসিএ বিভাগে কয়েক বছর আগে শিক্ষকের চাহিদা দিলেও শিক্ষক নিয়োগের জটিলতা কাটছেই না। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন নিরাপত্তাকর্মীকে দিয়ে ক্লাস নিতে নিষেধ করা হয়েছে মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে।

জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে স্থাপিত এ মাদরাসাটি ১৯৯৮ সালে এমপিওভুক্ত হয়। এরপর ক্রমাগতই ভালো ফলাফল করলেও বর্তমানে ওই মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ফলাফল খারাপ হওয়ায় গত দুই বছর ধরেই স্বীকৃতি নবায়ন বন্ধ হয়ে আছে।

সরেজমিনে বোধখানা মহিলা দাখিল মাদরাসায় গিয়ে দেখা যায়, নামমাত্র চলছে এ মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রম। মাদরাসাটিতে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা ২০৭ জন। এর বিপরীতে শিক্ষক থাকার কথা ১৮ জন। তবে বর্তমানে শিক্ষক রয়েছে মাত্র ১৩ জন। বাকি পাঁচ জন শিক্ষক সংকটের কারণে টালমাটাল এ মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষক সংকটে ভেঙে পড়েছে পড়াশোনার মানও। শিক্ষকের সংকট সামাল দিতে চলতি বছর টানা ১০ মাস ওই মাদরাসার নিরাপত্তাকর্মী তহিদুজ্জামান রনিকে দিয়ে ক্লাস করিয়েছেন মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। 

শিক্ষা বিভাগের নীতিমালা অনুযায়ী মাদরাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় প্রতিবার কমপক্ষে তৃণমূল পর্যায়ে ১৮ জন পরীক্ষা দিয়ে কমপক্ষে ৯ জনকে পাস করতে হবে। কিন্তু ওই মাদরাসা থেকে প্রতিবারই গণিত বিষয়ের ওপর অকৃতকার্যের হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গত দুই বছর যাবৎ স্বীকৃতি নবায়ন পায়নি মাদরাসাটি। 

বোধখানা মহিলা দাখিল মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার জহুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মাদরাসায় পাঁচজন শিক্ষকর সংকট। এনটিআরসিএ বিভাগে শিক্ষকের জন্য আবেদন দিয়েছি, তবে এখনো কোনো সুরহা পাইনি।

তিনি বলেন, শিক্ষক সংকট ছিল এজন্য চলতি বছরের শুরুর দিক থেকে চলতি মাস পর্যন্ত মাদরাসার নিরাপত্তাকর্মীকে দিয়ে ক্লাস করিয়েছিলাম। তাও শুধুমাত্র প্রথম শ্রেণির ক্লাস। পরবর্তীতে শিক্ষা অফিসার নিষেধ করলে আর ক্লাস করাইনি। আমার মাদরাসার নিরাপত্তাকর্মী তহিদুজ্জামান রনি ডিগ্রি পাস।

মাদরাসার নিরাপত্তাকর্মী তহিদুজ্জামান রনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ২০১২ সালে এসএসসি পাস করেছি। ২০১৯ সালে ২ দশমিক ৫১ জিপিএ পেয়ে ডিগ্রি পাস করেছি। এরপর যশোর এমএম কলেজে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার পর করোনার কারণে আর আর্থিক সমস্যায় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি বলেন, আমি ২০২১ সালে এ মাদরাসায় নিরাপত্তাকর্মী পদে যোগদান করি। স্যাররা বলেছিল এজন্য আমি শুধুমাত্র প্রথম শ্রেণির ক্লাস নিতাম। পরে নিষেধ করলে আর নেইনি।

মাদরাসার সহকারী শিক্ষক আশরাফুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো শিক্ষকই চায় না যে একটা মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের দিকে চলে যাক। অনেক সংকট জটিলতার পরেও এ মাদরাসাটিকে শিক্ষকরাই টিকিয়ে রেখেছে। একটা মাদরাসায় পাঁচ জন শিক্ষক সংকট থাকা মানে বাকি শিক্ষকদেরও পানি খাওয়ার সময় থাকে না।

তিনি বলেন, আমাদের নিরাপত্তাকর্মী শিক্ষিত। এজন্য তাকে দিয়ে ক্লাস নেওয়ানো হয়েছিল। তাও শুধুমাত্র প্রথম শ্রেণির।

বোধখানা মহিলা দাখিল মাদরাসার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুরাইয়া খাতুন ঢাকা পোস্টকে জানায়, আমাদের মাদরাসায় শিক্ষক সংকট। অনেক সময় স্যাররা কেউ ছুটিতে থাকলে আমাদের ক্লাস গ্যাপ যায়।

আরেক শিক্ষার্থী তাসনিম আক্তার বৃষ্টি জানায়, শিক্ষক না থাকায় আমাদের অনেক সময় ক্লাস বাদেই বসে থাকতে হয়। শিক্ষক পরিপূর্ণ হলে আমাদের পড়াশোনার মানও বৃদ্ধি পাবে।

তবে এ বোধখানা মহিলা দাখিল মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশার কারণ হিসেবে বর্তমান ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকে দায়ী করছেন সাবেক সভাপতি ও এলাকাবাসী।

মাদরাসার সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সাইফ বলেন, আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমার পূর্ব পুরুষরা এই মাদরাসার জন্য ১৯৭০ সালে জমি দান করেছিলেন। আমি এ মাদরাসার সভাপতি থাকাকালীন নিরাপত্তাকর্মী তহিদুজ্জামানের নিয়োগ হয়। মাদরাসার শিক্ষকদের সেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করায় আমাকে ষড়যন্ত্র করে সভাপতি পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর ডিও পত্রের মাধ্যমে বর্তমান সভাপতি এসএম মশকুর আলম দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

তিনি বলেন, বর্তমান সভাপতি দায়িত্বে আসার পর থেকেই এমন টালমাটাল অবস্থায় চলছে বোধখানা মহিলা দাখিল মাদরাসাটি।

মাদরাসার বর্তমান সভাপতি এসএম মশকুর আলম জানান, মাদরাসায় শিক্ষক সংকট থাকায় নিরাপত্তাকর্মীকে দিয়ে ক্লাস করানো হয়েছিল। সাবেক সভাপতি থাকতে মাদরাসার কোনো উন্নয়ন হয়নি। ওই সময় দুটি নিয়োগের পর মাদরাসার অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা ছিল না। সমুদয় টাকা আমার পকেট থেকে খরচ করেছি।

তিনি বলেন, মাদরাসার উন্নয়নের কথা চিন্তা করে কাজ করে যাচ্ছি। খুব দ্রুত সব সমস্যার সমাধান হবে।

স্থানীয় এলাকাবাসী শামীম হোসেন বলেন, সাবেক সভাপতি থাকতে আমরা কখনও এ মাদরাসায় নয়-ছয়ের খবর পাইনি। বর্তমান সভাপতি আসার পরেই আমরা নানারকম সমস্যার কথা শুনছি।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জাহাঙ্গীর হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিরাপত্তাকর্মী দিয়ে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে আমি জানতে পেরেছি। সুপারকে কৈফিয়ত তলব করলে তিনি নিরাপত্তাকর্মী দিয়ে ক্লাস নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এমন কাজ আর করবেন না বলেও তিনি জানিয়েছেন। 

তিনি বলেন, তাদের শিক্ষক সংকট, তারা এনটিআরসিএতে আবেদন করলে শিক্ষক পাবে। আশা করি দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।

এ্যান্টনি দাস অপু/এমএএস