বাগানে ১৮৯টি নারকেলগাছ। তবুও ডাব কিনে খেতে হয়- এমন আক্ষেপ ভিয়েতনামী নারকেল বাগান মালিক আতাউর রহমানের। 

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে রাজশাহী হর্টিকালচার সেন্টার থেকে প্রতিটি ৫০০ টাকা দরে ভিয়েতনামী জাতের ডাবগাছের চারা কিনে বাগান করেছেন রাজশাহীর পবা উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের চাষি বজলুল হক ও তার ছেলে আতাউর রহমান। তিন বিঘা জমিতে ১৮৯টি নারকেলগাছের চারা রোপণ করে বাগান করেছিলেন তারা।

রোপণের কয়েক দিনের মাথায় ৩০টি নারকেলগাছ মারা যায়। এরপরে তারা একই দামে ৩০টি ডাবগাছ কিনে আবার রোপণ করেন। সেই সময় হর্টিকালচার সেন্টার থেকে বজলুর রহমানকে জানায়, গাছে তিন বছরে ডাব আসবে। এই কথায় তিনি নারকেল বাগান করেছিলেন। কিন্তু নারকেলগাছ রোপণের ছয় বছরেও ঠিকমতো ডাব আসেনি তার গাছে। এতে তিনি হতাশ। কারণ জমি লিজ নিয়ে বাগান করে ছয় বছরে তার খরচ হয়েছে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। কিন্তু তার বাগানে বর্তমানে ৩০ শতাংশের কম গাছে ডাব এসেছে।

আতাউর রহমান বলেন, এবছর সর্বোচ্চ ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে একটি ডাব। এমন অবস্থায় ডাবের দাম শুনে শুধু আফসোস করেছি আমি। আমার বাগানের সব গাছগুলোতে ১০টি করেও ডাব আসলেও অনেক টাকার ডাব বিক্রি করতে পারতাম। ডাব বিক্রি করে বাগানে খরচ হওয়া অনন্ত কিছু টাকা হলেও উঠে আসতো।  

বজলুলু হক বলেন, একটানা ছয় বছর পরিশ্রম দিয়ে গাছগুলো বড় করেছি। অনেকটাই শিশুর মতো যত্ন করে বড় করে তুলেছি। হর্টিকালচার সেন্টার থেকে বলেছিল, গাছের বয়স তিন বছর হলে ডাব ধরবে। ডাব ধরেছে কিন্তু কয়েকটা গাছে। সব গাছে ডাব আসেনি। কবে আসবে কে জানে। গাছগুলো বড় হয়ে গেছে। এখন কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না। না পারছি কাটতে, না পারছি কিছু করতে। কিন্তু প্রতিবছরই সার কীটনাশক বাবদ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে ডাব বাগানে। কিন্তু গাছে ডাব আসছে না।

ভিয়েতননামী ডাবেরগাছ নিয়ে অভিযোগ করে বজলুল হকের ছেলে আতাউর রহমান বলেন, ভিয়েতনামী বলে আমাদের এক জাতের ডাবের গাছ দেওয়া হয়নি। এখানেও প্রতারণা করা হয়েছে। কয়েক ধরনের ডাবের গাছ দেওয়া হয়েছে। একসময়ে ডাবগাছ লাগিয়েআও কোনটির উচ্চতায় চার থেকে পাঁচ ফুট আবার কোনটি ১০ থেকে ১২ ফুট। আমার ধারণা যে নারকেলগাছগুলো ছোট সেগুলো ভিয়েতনামী জাতের ডাবগাছ। কিন্তু বড় গাছগুলো অন্য জাতের। তবে ছোট বড় কোন গাছেই কাঙ্ক্ষিত ডাব আসেনি। ডাব না এলেও প্রতি বছরই খরচের পাল্লা ভারি হচ্ছে তাদের।

সরেজমিনে ডাব বাগানে গিয়ে দেখা গেছে, ভিয়েতনামী জাতের হলেও বিভিন্ন আকারের ডাবগাছ রয়েছে বজলুল হকের বাগানে। কিন্তু গাছগুলো উচ্চতায় খাটো হওয়ার কথা ছিল। গাছগুলোর মধ্যে ৫০ থেকে ৫৫টিতে ছোট ছোট ডাব দেখা গেছে। সেই গাছগুলোতে গত দুই বছর থেকে কয়েকটি করে ডাব আসছে। তবে বাগানের বেশিরভাগ গাছেই ফাঁকা।

আতাউর রহমান দাবি করে বলেন, এগুলো বিদেশী জাতের ডাবের গাছ। হর্টিকালচার সেন্টারের দেওয়া পরামর্শে পরিচর্যা করা হয়েছে। তবুও কাঙ্ক্ষিত ডাব ধরেনি গাছে। এই জমিতে ভিয়েতনামী জাতের গাছ রোপণ না করে দেশি জাতের ডাবগাছ রোপণ করা হলে ছয় বছরে কম করে হলেও ৭০ শতাংশ গাছে ডাব আসতো। কিন্তু ভিয়েতনামী জাতের ডাবের চারা রোপণ করে গত বছর ২৫০টি ডাব পাওয়া গেছে। ঠিকঠাক ভাবে গাছে ডাব আসলে হাজারেরও বেশি ডাব পাওয়া যেত। কিন্তু ডাব নেই বাগানে। শুধু খরচই হচ্ছে।

আতাউর রহমান বলেন, হর্টিকালচার সেন্টার থেকে বলেছিল তিন বছরে ডাব ধরবে। তিন বছরে মাত্র কয়েকটি গাছে ডাব ধরেছে। ডাব ধরবে ধরবে করে ধরেনি। এখানে ছোট গাছগুলোতে কয়েকটা ধরলেও বড় গাছগুলোতে ডাব ধরেনি। পুরো বাগানের ১৮৯টি গাছের মধ্যে মাত্র ৪০ থেকে ৪৫টি গাছে ডাব এসেছে। গত বছর ৩০ টা ও তার আগের বছর ২০ গাছে ডাব এসেছিল। গত বছর পেয়েছি ২৫০টি। এখানে হাজার হাজার ডাব হওয়ার কথা। একটা গাছে ২০০ করে ডাব আসলে ৪০ হাজার ডাব হয়। সেখানে মাত্র ২০০ থেকে ২৫০টি ডাব হচ্ছে। বড় গাছগুলোতে ডাব আসেনি।

তিনি আরও বলেন, ডাবের গাছগুলো কোর্ট এলাকার হর্টিকালচার সেন্টার থেকে কেনা। তারা একজাতের (ভিয়েতনামী) বলে দিয়েছিল। কিন্তু নারকেলগাছগুলো রোপণের কয়েক বছর পরে আকৃতি দেখে মনে হচ্ছে কয়েক জাতের গাছ দিয়েছে আমাদের। একই সময়ে লাগিয়ে কিছু গাছ অনেক বড় হয়ে গেছে। কিছু গাছ ছোট হয়ে আছে। আমারা বুঝতে পারলে ছোট জাতের নারকেলগাছগুলো একদিকে লাগাতাম। বড় জাতের গুলো অন্য দিকে লাগাতাম। তাহলে কারো ছায়া কারো উপরে পরতো না। তারা তো এক জাত বলে দিয়েছে। এখন তো আমরা তাদের কিছু বলতে পারছি না।

ছয় বছরে মাত্র ৩০ শতাংশ গাছে ডাব এসেছে দাবি করে আতাউর রহমান ঢাকা পোস্টাকে বলেন, গাছের ১০ বছর বয়স হলেও সব গাছে ডাব পাব কি না ঠিক নাই। হর্টিকালচার সেন্টার থেকে বলেছি তিন বছর থেকে সব গাছেই ডাব ধরবে। কিন্তু ধরেনি। আগামী ডিসেম্বরে গাছের ছয় বছর বয়স হবে। কিন্তু ৫০ শতাংশ গাছেও ডাব আসেনি। এখন ৫০ থেকে ৫৫টা গাছে ডাব আছে। হিসেব করে দেখা যায় মাত্র ৩০ শতাংশ গাছে ডাব এসেছে। 

তিনি বলেন, গাছগুলো তৈরি করতে অনেক টাকা ব্যয় হয়েছে। এছাড়া সার কিটনাশক বাবদ প্রতি বছরে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়। গাছগুলাতে ডাব না আসার বিষয়ে হর্টিকালচার সেন্টারে যোগাযোগ করা হলে তারা বিভিন্ন সার-বিষ দিতে বলে। সেগুলো দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। গাছগুলো কাটলে তো আরও লোকসানে পড়ে যাব। এখনও দুই বছর দেখি। গাছগুলো আরও বড় হোক। 

নাটোর জেলা সদরে ২০১৬ সালে প্রথম ভিয়েতনামী ডাবের বাগান করেছিলেন মো. সেলিম। তিনি দাবি করে বলেন, দেশ প্রথম ভিয়েতনামী ডাবের বাগান তার। কিন্তু ফলাফল শূন্য। তার থেকে দেশী ডাবের বাগান করা অনেক ভালো। দেশি ডাবের বাগানে ভালোভাবে পরিচর্যা করলে তিন বছর বয়স থেকে সারাবছর ডাব পাওয়া যায়।  

রাজশাহী হর্টিকালচার সেন্টারের উদ্যানতত্ত্ববিদ কাজী ইফফাত তামান্না বলেন, ভিয়েতনামী জাতের ডাব গাছে ডাব পেতে হলে পরিচর্যার বিকল্প নেই। গাছে প্রতিদিন পানি দিতে হবে। বছরে চার বার সার দিতে হবে। এগুলো না করতে পারলে গাছে ডাব আসতে দেরি হবে। বাগানের মালিক হয়তো পরিচর্যা করেনি বা করতে পারেনি। তাই কাঙ্ক্ষিত ডাব পাননি।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, গাছগুলো নিয়ে আসার আগে রিসার্চ করার দরকার ছিল। মাটি ও অবহাওয়া গত অনেক ব্যাপার থাকে। এখন দেখা যাচ্ছে কোনটি লম্বা, কোনটি খাট। আবার আড়াই থেকে তিন বছরে ডাব ধরার কথা বললেও গাছে ডাব কম আসে। এছাড়া গাছের রোগ বালাই বেশি। ভিয়েতনামী জাতের ডাবের গাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ডাব পাওয়া যাচ্ছে না। ডাবগাছে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। রাজশাহীতে এমনিতে পানি কম হয়। এর প্রভাব রয়েছে। এছাড়া নিয়মিত সার দিতে হয়। পরিচর্যায় ঘাটতি হলে ডাব কম আসবে।

শাহিনুল আশিক/আরকে