প্রযুক্তির চাপে ঐতিহ্য হারাচ্ছে কুটির শিল্প, ভালো নেই কারিগর
কালের বিবর্তনে পেশাগত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে কুটির শিল্প। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো মাদারীপুর অঞ্চলের কুটির শিল্পের কারিগররাও এখন আর খুব একটা ভালো নেই। নিজেদের জাত পেশা ছেড়ে অনেকেই এখন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন অন্য পেশা।
এরপরেও হাতেগোনা কয়েকজনের মতো বেতকেই জীবিকার প্রধান বাহক হিসেবে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের কুটির শিল্পের কারিগর শাহ আলম আকন। এই বেতই বর্তমানে তার জীবিকার প্রধান বাহক।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু দিন দিন বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় ভালো নেই এই কারিগর। যদিও অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাপ-দাদার এই পেশাকে এখনও আঁকড়ে ধরে রেখেছে শাহ আলমের পরিবার।
আধুনিক প্রযুক্তির যুগে মাদারীপুর সদর উপজেলায় বেত শিল্পের তৈরি মনকাড়া বিভিন্ন জিনিসের জায়গা করে নিয়েছে স্বল্প দামের প্লাস্টিক ও লোহার তৈরি পণ্য। তাই বেতের তৈরি মনকাড়া সেই পণ্যগুলো এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। কদর না থাকায় গ্রামগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বেতের তৈরি ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় আকর্ষণীয় খেলনাপাতি ও আসবাবপত্র।
বিজ্ঞাপন
অভাবের তাড়নায় এই শিল্পের কারিগর বাপ-দাদার দীর্ঘদিনের পেশা ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ছুটে গিয়েও ফিরে এসেছেন। শত অভাব অনটনের মাঝেও উপজেলায় হাতে গোনা কয়েকজন কারিগরের মধ্যে আজও পৈত্রিক এই পেশাটি আঁকড়ে ধরে রেখেছেন শাহ আলম আকন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের এটিএম বাজার এলাকায় মৃত ইউসুফ আকনের ছেলে শাহ আলম আকন (৬৫) ১৯৯৩ সালে থেকে বাপ-দাদার ঐতিহ্য এই কুটির শিল্পের কাজ ধরে রেখেছেন। দীর্ঘ কয়েক বছর ভালোই চলছিল তার মনকাড়ানো এই কুটির শিল্প ব্যবসা।
কয়েক বছর আগে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে কাজ থমকে গিয়েছিল, তারপরও বাপ-দাদার এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে চলছেন এই কুটিরশিল্প কারিগর। তার তৈরিকৃত সরঞ্জামগুলো হলো- ছোট বাচ্চাদের খেলনাপাতি ও ঘরে সাজিয়ে রাখার বাহারি রকমের পণ্য, হুইলচেয়ার, দোলনা, পালকি, খাট, গোলচেয়ার সেট, সোফাসেট, ঝুড়ি, ব্রাস্ট বক্স, টেবিল, বাপুরাম-সাপুড়ে, নৌকা, ফুলের টব, আসবাবপত্র, কলমদানিসহ মন রাঙানো আরও অনেক কিছু।
ক্ষুদ্র কুটির শিল্প উদ্যোক্তা শাহ আলম বলেন, আমি বহুবছর যাবত কুটির শিল্পের পুরোনো ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছি। তবে আমি এখন আর পারছি না। প্লাস্টিকের পণ্যের জোয়ারে এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের কাছে আকুল আবেদন করছি।
তিনি আরও বলেন, করোনা মহামারির পর থেকে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের পণ্য ঠিক মতো চলে না। সরকার সহযোগিতা করলে এসব পণ্য আমরা বিদেশে রপ্তানি করতে পারি। এছাড়া বাপ-দাদার ঐতিহ্য কুটির শিল্পের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।
স্থানীয় বাসিন্দা আবু রায়হান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঐতিহ্যবাহী শিল্পের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পণ্যের বাজার সৃষ্টি করা, প্লাস্টিকের অবাধ ব্যবহার কমানো, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
দানিয়াল নামে স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, শাহ আলমের তৈরি শিল্প আমরা মাঝে মাঝে দেখতে আসি। তিনি এতো সুন্দর জিনিসপত্র তৈরি করেন যে সেগুলো দেখতে অনেক ভালো লাগে। আমাদের দাবি, সরকার যেন তার তৈরি পণ্যগুলো বাজারে বিক্রি করার ব্যবস্থা করে দেয়।
কুটির শিল্পের এই উদ্যোক্তার স্ত্রী রেবেকা সুলতানা বলেন, আমার স্বামী ছোট বয়সে তার বাপ-দাদার থেকে এই শিল্পের কাজ শিখেছে। এজন্য অন্য কোনও কাজ করতে পারে না। আমরা সবাই মিলে এই কুটির শিল্পের কাজে তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করতাম। করোনার পর থেকে বেতের দাম অনেক বেশি হওয়ায় তেমন পণ্য বিক্রি করতে পারে না। সরকার যদি আমাদের সহায়তা করে তাহলে আমরা পুরোনো এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারবো।
পরিবেশবান্ধব ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে ইউপি সদস্য বাদল বেপারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পী হিসেবে শাহ আলম অনেক ভালোমানের কাজ জানেন। তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখার অনুরোধ করছি।
ঐতিহ্যবাহী বেত শিল্পের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদিন মোল্লা জানান, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে প্রতিটি কৃষক পরিবারের অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী হলো এইসব জিনিস। কৃষি শস্য সংরক্ষণ এবং প্রতিদিন ব্যবহার্য এসস পণ্যের বিকল্প কখনোই প্লাস্টিক সামগ্রী হতে পারে না। পরিবেশবান্ধব এ কুটির শিল্পকে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এ বিষয় মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুল রসিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুরোনো ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বপ্রথম তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এছাড়াও কুটির শিল্প উদ্যোক্তা শাহ আলমকে সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা করা হবে।
রাকিব হাসান/টিএম