প্রতিটি গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝুলে আছে কমলা। প্রথম দেখাতে যে কারও মনে হতে পারে এটা বিদেশের কোনো ফলের বাগান। কিন্তু না, বাগানটি করেছেন শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানার দক্ষিণ তারাবুনিয়া ইউনিয়নের জাফর আলী মাল কান্দি গ্রামের খলিলুর রহমান মাল। প্রবাসী ছেলে শামসুর রহমানের পরামর্শে পরিত্যক্ত জমিতে বালু ও মাটি দিয়ে ভরাট করে চায়না কমলার গাছ লাগিয়ে ভালো ফলন হওয়ায় গ্রামের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। গত বছর থেকে ফলন শুরু হলেও এ বছর ফলন হয়েছে বেশ ভালো। বাজারে চায়না কমলার চাহিদা ভালো থাকায় লাভবান হবেন বলে প্রত্যাশা তার।

স্থানীয় ও খলিলুর রহমানের পরিবার সূত্রে জানা যায়, প্রবাসী শামসুর রহমান অবসর সময়ে ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও দেখেন। ভিডিওতে হঠাৎ দেখতে পান চুয়াডাঙ্গার এক কৃষক বাণিজ্যিকভাবে চায়না ফলের চাষ করছেন। প্রবাসে থেকেই চারা সংগ্রহের জন্য তিনি ওই কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরবর্তীতে বাড়িতে থাকা বাবা খলিলুর রহমান ও ছোট ভাই রোকন মালকে পরামর্শ দেন কমলার চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে। এরপর ৩২ শতাংশ জমি বালু ও মাটি দিয়ে ভরাট করে ১৫০টি চারা সংগ্রহ করে রোপণ করেন। এক বছরের পরিচর্যায় গত বছর থেকে বাগানে ফলন শুরু হয়। আত্মীয়-স্বজনদের দিয়েও গত বছর এক লাখ টাকার কমলা বিক্রি হয়েছিল। এ বছর ফলন আরও ভালো হওয়ায় গতবারের চেয়ে বেশি লাভবান হওয়ার আশা করছেন খলিলুর রহমান ও রোকন মাল।

খলিলুর রহমান

ফলের বাগানে ঘুরতে আসা রুহুল আমিন জুয়েল ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিকেলে ঘুরতে বের হয়েছিলাম। এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম কমলার বাগান। অনেককে ছবি তুলতে দেখে আমিও বাগানে এসেছি। অল্প একটু জায়গার মধ্যে এত কমলা হয় তা আমার ধারণা ছিল না। বিশেষ করে চায়না কমলা। এটা তো আমার কল্পনার বাইরে ছিল। বাজারে যে কমলা পাওয়া যায়, তাতে ফরমালিন দেওয়া থাকে। এখন যেহেতু সখিপুরের মাটিতেই চায়না ফল চাষ হয়েছে, আগামী দিনে অল্প দামে এই বাগান থেকে ফরমালিনমুক্ত ফল কিনতে পারব। তরুণ বেকার যারা রয়েছেন, তারা চাইলে এমন বাগান করে বেকারত্ব দূর করতে পারেন।

ইমামুল নামে আরেকজন বলেন, ভেবেছিলাম বাজার থেকে কমলা কিনব। কিন্তু খবর পাই এই বাগান থেকে অল্প দামে ভালো কমলা কেনা যাবে। এই বাগানের কমলা খেয়েছি, বেশ মিষ্টি। বাগানের মালিক থেকে কমলা কিনেছি।

সজিব নামে এক স্কুলশিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলে, প্রথম যখন এখানে চারাগুলো রোপণ করে, তখন ভেবেছিলাম জাম্বুরা গাছ। কিন্তু বড় হওয়ার পর এখন দেখতেছি এগুলো চায়না কমলা গাছ। অনেক দূর থেকে এখানে মানুষ আসে, ছবি তোলে। আমার কল্পনায়ও ছিল না যে আমার বাড়ির পাশে কমলা বাগান হবে। বাগানে ঘুরতে এলে আমার বেশ ভালোই লাগে।

ওহিদুল্লাহ নামে এক প্রবাসী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদেশের মাটিতে আমরা অনেক কষ্ট করি। ছুটিতে বাড়িতে এসে দেখলাম আমার বাড়ির পাশেই কমলার বাগান। বাগানটি দেখে আমার বেশ ভালো লেগেছে। স্থানীয় কৃষি বিভাগ যদি বাগানটিকে সব সময় দেখাশোনা করত তাহলে যে ফুলগুলো ঝরে গেছে, তা ঝরত না। ফলন আরও বেশি হত। আমার মতো তরুণরা বিদেশের মাটিতে না গিয়ে দেশেই এমন ফলের বাগান করে স্বাবলম্বী হতে পারত। কৃষি বিভাগের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে তারা যেন এই বাগানটিকে দেখাশোনা করেন। তাহলে অনেক তরুণ এমন বাগান করতে উদ্বুদ্ধ হবে।

বাবার সঙ্গে ফলের বাগানটির পরিচর্যা করা রোকন মাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, সৌদি আরব প্রবাসী ভাই শামসুর রহমানের পরামর্শেই বাগানটি করা হয়েছে। মাটি, সার, ওষুধ দিয়ে বাগানটি তৈরি করা হয়েছে। গত বছরও ফলন হয়েছিল। আত্মীয়-স্বজনদের উপহার দিয়েও যথেষ্ট বিক্রি করতে পেরেছি। এ বছর ফলন আরও ভালো হয়েছে। তবে কিছু কমলা নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষি অফিস থেকে যদি আমাদের বাগানের খোঁজখবর নিত তাহলে এভাবে ঝরে যেত না। তারপরও ইনশাল্লাহ এ বছর বেশ ভালো বিক্রি করতে পারব।

রোকন মাল

খলিলুর রহমান মাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউটিউবে দেখে আমার ছেলে চুয়াডাঙ্গা থেকে কমলার চারাগুলো সংগ্রহ করেছে। পরিত্যক্ত জমি ভরাট করে বাগানটি করেছি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। গত বছর আত্মীয়স্বজনদের দিয়েছি, নিজেরাও খেয়েছি। এ বছর বুঝতে না পারায় সঠিক সময়ে স্প্রে করতে পারিনি, তাই কিছু ফল নষ্ট হয়ে গেছে। যে ৩২ শতাংশ জমিতে বাগান করেছি, তাতে অন্য ফসল করলে এতটা লাভবান হওয়া যেত না। নষ্ট হওয়ার পরেও যে ফলন হয়েছে, তাতে আমরা খুশি। লাখ টাকার উপরে বিক্রি করতে পারব।

শরীয়তপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. রবীআহ নূর আহম্মেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রামের মধ্যে কমলার বাগান বিষয়টি অত্যন্ত আনন্দের। প্রথমদিকে আমরা খোঁজখবর রাখতে পারলে পরবর্তীতে সেটা আর সম্ভব হয়নি। কারণ শরীয়তপুরের কৃষি বিভাগে উপসহকারী থাকার কথা ছিল ২০১ জন। কিন্তু সেখানে জনবল অর্ধেকেরও কম। এছাড়া যদি একটু আন্তরিক হয়ে খলিলুর রহমান বিষয়টি কৃষি বিভাগকে জানাতেন তাহলে হয়ত বাগানের যে ফলগুলো ঝরে গেছে, তা ঝরে পড়ত না। এখন থেকে নিয়মিত কমলার বাগানটির খোঁজখবর রাখবে কৃষি বিভাগ।

এমজেইউ