কথিত ধর্ষণ মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার সেই তিন শিশু

‘তিন মাস শ্যাষ। এহনও পোলায় রাইতে ‘পুলিশ পুলিশ কইয়া’ চিক্কর (চিৎকার) দিয়া ওডে। জানি না মামলার কি অয়। পোলাকে এহনও সুস্থ হরতে পারি নাই। একটা মিথ্যা মামলায় জড়াইয়া এই পোলারতো ভবিষ্যৎ আন্ধার।’ কথাগুলো বলছিলেন কথিত ধর্ষণ মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার ৯ বছরের শিশু হাফিজুল ইসলাম লাবিবের মা লাকি বেগম। 

তিনি আরও বলেন, ডরে মোরা কারও লগে কতা কই না। কেডা আবার কোন মামলায় ফাঁসায়! এক ঘরের মানুষ, গুড়াগারা (ছেলেমেয়ে) লইয়া এক ঘরেই থাহি। লাগলে গ্রাম ছাইড়া চইলা যামু, হেরপরও পোলারে মুই পুলিশের হাতে দিতে পারমু না। কথাগুলো বলতে বলতে তার গলা ধরে আসে। আঁচলে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদেন তিনি। পাশেই হাফিজুল মায়ের গলা জড়িয়ে আঁচলে মুখ লুকায়। 

এই কান্না শুধু একদিনের নয়; পুলিশি আতঙ্ক, মামলার ভয় লাকি বেগমের পরিবারে নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই আতঙ্ক বাকি তিন শিশুর পরিবারেও। ইতোমধ্যে কথিত মামলায় প্রধান অভিযুক্ত সাইদুল ইসলামকে গ্রামছাড়া হতে হয়েছে। 

সাইদুলের বাবা বেল্লাল বয়াতী বলেন, কখন কি ঘটে সেই ভয়ে ছেলেকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছি। পুলিশের ভয়ে অন্তত ঘরে প্রস্রাব-পায়খানা আর করবে না। 

তিনি আরও বলেন, হাইকোর্ট ওদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার পর যে কয়দিন বাড়ি ছিল ও ঘর থেকে বের হয়নি। ঘরের চৌকির ওপরেই বসে থাকত। রাত হলে মাকে বলত আবার পুলিশ আইছে। পুলিশের আতঙ্কে ছেলেটা শুকিয়ে গেছে। হুজুরের কাছ থেকে পানি পড়া, তাবিজ এনে দিয়েছি। কিন্তু উপকার হয়নি। শেষে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছি।

সরেজমিনে গিয়েও খুঁজে পাওয়া যায়নি অপর দুই শিশু সোলায়মান ইসলাম তামিম ও শাওন হাওলাদারকে। শিশুদের স্বজনরা কিছুতেই বলতে রাজি হয়নি ওই দুইজন কোথায় আছে। 

শাওন হাওলাদারের বাবা শাহীন হাওলাদার বলেন, মাঝে মাঝে পুলিশ আসে। আমাদের চুপচাপ থাকতে বলে। নাহলে ঝামেলা হবে বলেও জানিয়ে গেছে কয়েকবার। 

তামিমের বাবা সালাম হাওলাদার বলেন, মামলার বাদী এলাকায় হুমকি দিয়ে বেড়ায়। মামলা ঝুলিয়ে রাখবে। শিশুদের বয়স ১৮ বছর হলে মামলা চালু দিয়ে সবাইকে সাজা দেওয়াবে। পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম। তারা আমাদের কোনো কথাই শুনতে চাই না।

 মায়ের সঙ্গে শিশু হাফিজুল

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারের পর বাড়ি ফিরে অস্বাভাবিক জীবনযাপন করছে এই চার শিশু। আগে ওদের কোলাহলে পুরো বাড়ি প্রাণবন্ত হয়ে থাকত, এখন সেখানে নির্লিপ্ততা। শিশুদের এমন পলাতক মানসিকতার পরিবেশে রাখলে ওদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। ক্ষতি হবে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠায়। 

দ্রুত ওদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা পঙ্কজ রায় চৌধুরী। তিনি বলেন, এই শিশুদের স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরিয়ে দেয়া সকলের দায়িত্ব। এ জন্য তাদের যেমন সুস্থ পরিবেশে প্রতিপালন করতে হবে তেমনি উদ্ভূত পরিস্থিতির পর চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শিশুরা যদি পুলিশি ট্রমার মধ্যে থাকে তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা থেকেই যায়।

এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি জেলা সমাজসেবা অফিসের প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ ও বাকেরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম। 

তবে মামলার বাদী জাহিদুর রহমান রুবেল দাবি করেছেন, মামলার সত্য-মিথ্যা সর্ম্পকে কোনো বক্তব্য নেই আমার। তবে জামিন পাওয়ার পর আসামিদের পরিবারের বিভিন্ন ধরনের হুমকিতে আমরা শঙ্কায় আছি। 

৯/১০ বছরের শিশু ধর্ষণ করতে পারে না-চিকিৎসকদের এমন বক্তব্যের বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রুবেল বলেন, কি ঘটেছিল সেদিন তা আমি দেখিনি। মেয়ে তার দাদির কাছে যা বলেছে সেই অনুসারে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছি। তখন প্রধান আসামির বোনও সঙ্গে ছিল। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার পুলিশকে ফোন দিয়েছে। তারপর মামলা হয়েছে।

যদিও বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সাবেক বিভাগীয় চেয়ারম্যান ডা. অসীম কুমার সাহা বলেন, ৯ বছরের শিশুদের শরীরে স্পাম বা সেক্স তৈরি হয় না। বৈজ্ঞানিকভাবে বিবেচনা করলে ৯ বছরের শিশুর দ্বারা ধর্ষণ অযৌক্তিক বলে আমার কাছে মনে হয়। 

শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শারীরিক পরীক্ষায় সেই শিশুকে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল পরিচালক ডা. বাকির হোসেন। তিনি বলেছেন, আমাদের রিপোর্ট আদালতে জমা দিয়েছি।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ৬ অক্টোবর (মঙ্গলবার) বরিশালের বাকেরগঞ্জে ৯ বছরের তিনজন এবং দশ বছরের একজনকে আসামি করে ধর্ষণ মামলা করেন পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জাহিদুর রহমান রুবেল বয়াতী। মামলায় ৪ অক্টোবর (রোববার) তার ৬ বছরের মেয়ে উল্লেখিত আসামি কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়। অভিযোগ দাখিলের দিনই মামলা গ্রহণ পুলিশ। তারা সমাজসেবা অফিসার ছাড়াই অভিযান চালিয়ে নাবালক চার শিশুকে গ্রেফতার করে। 

ভয়ে কুকড়ে গেছে পুলিশের হাতে গ্রেফতার এক শিশু (ফাইল ছবি)

৭ অক্টোবর (বুধবার) বরিশাল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এনায়েত উল্লাহর আদালত শিশুদের জামিন না মঞ্জুর করে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠান। শিশুদের কারাভ্যানে তোলার সময় তাদের আর্তনাদে হৃদয়র্স্পশী দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার হলে তা দৃষ্টিগোচর হয় উচ্চ আদালতের। 

বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রাতে তাৎক্ষণিকভাবে ভার্চুয়াল আদালতে চার শিশুর জামিনের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে বরিশালের শিশু আদালতের বিচারককে নির্দেশ দেন। পাশপাশি চার শিশুকে রাতের মধ্যেই তাদের অভিভবাকের কাছে পৌঁছে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী শুক্রবার সকাল ৭টায় যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে শিশুদের তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেন স্থানীয় প্রশাসন।

কেন এই মামলা

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, বাদী এবং বিবাদীর পরিবার পরস্পরেরর আত্মীয়। এদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ১৫ শতাংশ জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল। মূলত সাইদুলের বাবা বেল্লাল বয়াতীকে ওই জমি লিখে দিয়েছিল মামলার বাদী জাহিদুর রহমান রুবেলের দাদা। বিষয়টি জানতে পেরে মেনে নিতে পারছিল না রুবেল। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে বেশ কয়েকবার শালিসও হয়েছে। সর্বশেষ বাবুল শিকদারের বাড়ির সামনে একটি সাঁকো দিয়ে চলাচল করতো রুবেল। কিন্তু রোববার (৪ অক্টোবর) দুই পরিবারের ঝগড়ার সূত্র ধরে সেই সাঁকোটি তুলে ফেলা হয়। তখন দেখিয়ে নেয়ার হুমকি দিয়েছিল রুবেল। তারই দুইদিনের মাথায় থানায় ধর্ষণ মামলা হয়।

কেন একদিনেই ধর্ষণ মামলা নিলেন ওসি

মামলার বাদী জাহিদুর রহমান রুবেলের মা রেনু বেগম ওয়ার্ড জাতীয় পার্টির সক্রিয় কর্মী এবং ১২৪ বাকেরগঞ্জ সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য বেগম নাসরিন জাহান রতনার বাসায় থাকেন। উপজেলা জাতীয় পার্টির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা স্বীকার করেছেন, নাসরিন জাহান রতনা এমপির বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন এই রেনু বেগম। 

ধারণা করা হচ্ছে, থানায় অভিযোগ দিয়ে এমপির বাসা থেকে টেলিফোন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলাটি নিতে বলা হয়। যদিও ওসি আবুল কালাম এমন তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেননি। 

তিনি বলেছেন, ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনে দেশ উত্তাল। তাছাড়া বাদী লিখিতভাবে সুস্পষ্ট অভিযোগ দিয়েছেন। মামলা না নিলে তখন আবার আপনারাই (সাংবাদিক) উল্টো আমাকে বলতেন, মামলা কেন নিই নাই?

এসপি