সময় এবং জীবন কেউ কারও জন্য থেমে থাকে না। কখন কখনও সময় আমাদের এমন পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করায় তখন কোনো কিছু করার থাকে না। এমনই এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সুমনের পরিবার। ১২ বছরের কিশোর সুমনকে নিয়ে আজু আর হাসিনা বেগমের পরিবারের সুখেই দিন কাটছিল। তবে হঠাৎ করেই সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেল। একমাত্র ছেলেকে প্রতিদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে দেখে এখন দিশেহারা পরিবারটি।

অ্যাপলাস্টিক অ্যানিমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে সুমন মিয়ার চোখে মুখেও এখন ভয়ের ছাপ। কান দিয়ে পুঁজ বের হয়, নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়। ঠিকমতো বাথরুম সারতে পারে না। বাথরুম শক্ত হওয়ার কারণে পায়ুপথ দিয়েও রক্ত বের হয়। কোনো কিছুই তার ভালো লাগে না। চোখ-মুখ ফুলে গেছে তার। যে সময়টা তার দূরন্তপনার সময় ছিল, যে সময় খাতা কলম নিয়ে পড়ার সময় ছিল, সেই সময়টাতে সারাদিন তাকে মলিনমুখে বিছানায় পড়ে থাকতে হচ্ছে। সেই দৃশ্য দেখে তার বাবা-মা বোন সারাক্ষণ কাঁদছেন।

আজু রহমান ও হাসিনা বেগমের সর্বকনিষ্ট সন্তান সুমন মিয়া (১২)। তিন মেয়ে ও এক ছেলেই তাদের। সিলেট নগরের বেতের বাজার এলাকার সার মিয়ার কলোনিতে ২০ বছর ধরে বসবাস করে আসছেন তারা। পেশায় আজু রহমান দিনমজুর আর স্ত্রী হাসিনা বেগম গৃহিনী।

সুমনের বাবা আজু মিয়া জানান, মাস তিনেক আগে জ্বর হয়েছিল সুমনের। কিছুতেই জ্বর কমছিল না। জ্বরের সঙ্গে প্রায়ই মাথা ঘুরাত। নাক দিয়ে রক্ত পড়ত। ডাক্তারের কাছে নেয়া হলে পরীক্ষা নিরীক্ষা পর তার অ্যাপলাস্টিক অ্যানিমিয়া রোগটি ধরা পড়ে।

অ্যাপলাস্টিক অ্যানিমিয়া হলো এমন এক ধরনের রোগ যা মানবদেহের শরীরের বোনম্যারোতে রক্তসঞ্চয় বন্ধ করে দেয়। সেই রোগ সুমনের শরীরে ধরা পড়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে সে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে।

সুমনের বাবা বলেন, আমি পেশায় দিনমজুর। কখনও রিকশা চালাই, কখনও কামলা খাটি। যে টাকা রোজগার করি সেই টাকা দিয়ে পরিবারের খরচ চালাতেই আমাকে হিমশিম খেতে হয়। এর মধ্যে ছেলের চিকিৎসার জন্য এত টাকা কীভাবে জোগাড় করব সেই চিন্তায় আমাদের ঘুম হয় না। ছেলের মুখের দিকে তাকাতেই পারি না। কান্নায় চোখ দুটি ভিজে যায়।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুমনের মা হাসিনা বেগম বলেন, একমাত্র ছেলেকে এভাবে সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে আমার আর সহ্য হয় না। বুকটা ফেঁটে যায়। সেও (সুমন) লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত এলে ভয়ে সেটিও লুকিয়ে রাখতে চায় আমাদের কাছে। চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। এত টাকা আমরা কীভাবে সংগ্রহ করবো জানি না। মানুষের কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই আমাদের।

এখন প্রতিমাসেই সুমনের শরীরে রক্ষ সরবরাহ করতে হয়। গতমাসেও সুমনের শরীরে ৪ বার রক্ত দিতে হয়েছে। গত দেড় মাস আগে সুমনের শরীরের রক্ত সংগ্রহের জন্য তার বাবা মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন মানবিক টিম সিলেটের সদস্য সফি আহমেদ এর সঙ্গে। এরপর থেকে তার প্রতিদিনকার ৫০০ টাকার ওষুধ মানবিক টিমই সরবরাহ করে তাকে। পাশাপাশি সুমনকে ডাক্তার দেখানো পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো সবকিছুই তিনি করে যাচ্ছেন। সফি আহমেদ পেশায় একজন পুলিশ সদস্য।

শনিবার (১১ এপ্রিল) সুমনকে নিয়ে মানবিক টিমের সফি আহমেদ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ নাজমুল ইসলামের কাছে নিয়ে যান। ডাক্তার তাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বেশ কিছু ওষুধ খেতে বলেছেন। ডাক্তারের বরাত দিয়ে সফি আহমদ জানিয়েছেন, ডাক্তার সাহেব আমাদেরকে জানিয়েছেন যে আমরা ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার মধ্যে  ঢাকায় নিয়ে তার বোনম্যারো বদলাতে পারবো। তবে এটার মাধ্যমে যে সে পুরোপুরি ভালো হবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাকে ভারতে নিয়ে গেলে খরচ বেশি হবে। তবে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা ৯০ ভাগ। 

সফি আহমেদ বলেন, হঠাৎ একদিন সুমনের বাবা বি-পজিটিভ রক্তের জন্য আমার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন। তখন রোগীর সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছেলের রোগের কথা বলেন। তখন আমি রক্ত সংগ্রহ করে দেই। পরে সন্ধ্যার দিকে হাসপাতালে আমি সুমনকে দেখতে যাই। পরবর্তীতে তার সব কাগজপত্র দেখে আমি নিশ্চিত হই যে সে অ্যাপলাস্টিক অ্যানিমিয়া রোগে ভুগছে। বর্তমানে তার চিকিৎসার যাবর্তীয় খরচ আমি ও আমার টিম বহন করছি।

প্রতিবেশী বেলাল আহমদ জুবেল বলেন, পরিবার নিয়ে প্রায় ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা আমাদের এলাকায় রয়েছেন। গরিব  মানুষ দিনমজুরি করে রোজগার করে। হঠাৎ করেই তাদের এক ছেলে সন্তানের ক্যান্সার ধরে পড়েছে। এ ব্যয়বহুল চিকিৎসা তার বাবার পক্ষে করানো সম্ভব নয়। আমরা যতটুকু পেরেছি আমাদের সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করেছি।

আরেক প্রতিবেশী মো. তাজউদ্দিন বলেন, সুমনকে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি চোখের সামনে। এখন এমন এক পরিস্থিতিতে  পড়েছে সুমনের পরিবার সেটি বলার মতো না। সুমন সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকে। তার মা-বাবা সারাদিন কাদে। তার যে রোগ  হয়েছে সেটির চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। তার বাবার পক্ষে এত টাকা জোগাড় করা কোনোভাবেই সম্ভব না। সুমনকে এভাবে  দেখে আমাদেরও মন ভালো না।

সুমনের চিকিৎসার জন্য তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে সিলেট জেলা  সমাজসেবা কার্যালয়েও আর্থিক  অনুদানের জন্য আবেদন করেছেন। অ্যাপলাস্টিক অ্যানিমিয়া রোগটির চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় সকলের কাছে সাহায্যের  আবেদন জানিয়েছেন সুমনের পরিবার। সুমনের বাবা আজু মিয়ার সোনালি ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর - ৫৬১৭৬০১০১১৩৫৪, মোবাইল নম্বর-০১৭৫১৬৩৭৫৭৪।

তুহিন আহমদ/এমএএস