যশোরে পিতৃ পরিচয়হীন গর্ভধারণ বাড়ছে ভবঘুরে নারীদের
পরিবার বিছিন্ন বা দুর্ঘটনার শিকার মানসিক প্রতিবন্ধী অনেক নারী-পুরুষকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় পথেঘাটে। যাদের নাম-পরিচয় জানে না কেউ। তবে বেশ কিছুদিন ধরে যশোরে ভবঘুরে মানসিক ভারসাম্যহীন নারীদের গর্ভধারণ এবং পিতৃ পরিচয়হীন সন্তান প্রসবের ঘটনা বেশ আলোচনায় এসেছে।
সমাজে ঘটে যাওয়া এ ধরনের ঘটনাকে সামাজিক অবক্ষয় ও ব্যাধী হিসেবে মনে করছেন সচেতন মহল। তাদের দাবি মানসিক প্রতিবন্ধী নারীদের সঠিক নিয়মে রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে এ ধরণের পিতৃ পরিচয়হীন গর্ভপাত ও সন্তান জন্ম বন্ধ করা সম্ভব।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি এমন তিনটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে যশোর এবং খুলনায়। গত শনিবার (১৮ নভেম্বর) সন্ধ্যায় যশোরের চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয় আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে। গত দুদিন ধরে উপজেলার সিংহঝুলী ইউনিয়নের গরীবপুর গ্রামে অবস্থান করছিলেন ওই মানসিক ভারসাম্যহীন প্রসূতি। স্থানীয়দের মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে হাসপাতালে ভর্তি করে। এরপর মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) রাত ৮টার দিকে নরমাল ডেলিভারিতে ওই মানসিক ভারসাম্যহীন নারী এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. লুৎফুন্নাহার জানান, পরীক্ষার পর গাইনি চিকিৎসকরা ধারণা করছেন, নারীটির আগেও বাচ্চা হয়েছে এবং সেটাও নরমাল ডেলিভারিতে হয়েছে। সে কারণে এবারও ওই নারীর নরমাল ডেলিভারির জন্য হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে ভর্তি রাখা হয়েছিল। মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে নরমাল ডেলিভারিতে তার একটি কন্যা সন্তান হয়। মা বাচ্চা উভয়ই সুস্থ আছে।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, নবজাতকের মা মানসিক রোগী হওয়ায় তাকে চিকিৎসা দিতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক ও সেবিকাদের।
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর খুলনা রেলস্টেশন এলাকায় প্রসব বেদনায় ছটফট করছিলেন এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারী। অতঃপর স্থানীয়রা তাকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী রেলওয়ে হাসপাতালে ভর্তি করলে ওই নারী একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। এ ঘটনায়ও মানসিক ভারসাম্যহীন নারী মা হলেও নবজাতকের বাবার পরিচয় পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনার চারদিন আগে ৩ সেপ্টেম্বর যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার শ্রীপুর নতুন গ্রামের রাস্তায় দুটি যমজ সন্তান প্রসব করেন এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারী। সে সময় ওই মায়ের কাছে সন্তানদের বাবার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি একেক সময় একেক ব্যক্তির নাম বলেন। সন্তান প্রসবের পর ওই মা ও নবজাতকদের যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৮ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার পর সরকারি উদ্যোগে মানসিক ভারসাম্যহীন মাকে গাজীপুর ভবঘুরে সেন্টার ও নবজাতক দুটিকে পাঠানো হয় খুলনার ছোটমণি নিবাসে।
এদিকে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানো মানসিক প্রতিবন্ধী নারীদের মা হওয়ার ঘটনাকে সামাজিক অবক্ষয় ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করছেন সচেতন মহল ও মানবাধিকার কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, বর্তমান সময়ে মানুষ সচেতন হওয়া সত্ত্বেও এ ধরণের ঘটনা দুঃখজনক। এ সব মানসিক ভারসাম্যহীন নারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে।
যশোর সরকারি এমএম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মুস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানো মানসিক প্রতিবন্ধী নারীদের মা হওয়া বা গর্ভধারণ করার ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং বিস্ময়কর। নতুন শিশু পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখুক এটা সবাই চায়, তবে এভাবে একটা শিশু পিতৃ পরিচয়হীন ও একটি দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীতে আসুক এটা আমরা চাই না। এছাড়া এভাবে অবৈধ গর্ভপাতের ঘটনা বাড়ছে।
তিনি বলেন, এ ঘটনা রোধে সামাজিকভাবে কিছু দায়িত্ব রয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর এ সব ভবঘুরে মানিসক প্রতিবন্ধীদের নিরাপদে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করলে এ ধরণের অবৈধ গর্ভপাত বন্ধ করা সম্ভব।
রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, আমাদের দেশের অনেক সংগঠন আছে যারা প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে, তবে প্রয়োজনের সময় তাদেরকে পাওয়া যায় না। এমনি সময় তারা একটা-দুইটা হুইল চেয়ার দিয়ে কাজ সেরে ফেলে। কিছুদিন আগে বাঘারপাড়ার নবজাতক দুইটিকে নিয়ে আমাদের অনেক ধকল পোহাতে হয়েছে। সর্বশেষ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদেরকে আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়। আমি মনে করি সরকারি উদ্যোগ এবং প্রতিবন্ধীদের নিয়ে যারা কাজ করে তারা সকলে এগিয়ে এলে এ ধরণের ব্যাধি সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব।
সামাজিক বৈকল্যতা বা অবক্ষয়ের কারণে বর্তমানে এ ধরণের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে ভবঘুরে মানসিকতা ভারসাম্যহীন মায়েরা। তবে এ সব ভারসাম্যহীন মানুষদের জন্য যশোরে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই বলে জানালেন যশোর জেলা প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা মুনা আফরিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এ ধরণের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এ সব মানসিক ভারসাম্যহীন মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশু ও মায়েদের সর্বশেষ ঠিকানা হচ্ছে শিশু আশ্রম ও মানসিক আশ্রয়কেন্দ্রে।
তিনি বলেন, কিন্তু যশোরে এ ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধীদের নিরাপদে রাখার জন্য কোনো আশ্রয় সেন্টার নেই। এটি ঢাকা বিভাগের মধ্যে আছে। যশোরে থাকলে এ সব মায়েদের রক্ষণাবেক্ষণ করা যেত। অনেক সময় ভারসাম্যহীন মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশুদের পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেলেও তারা শিশুদের নিতে চায় না। পরে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে দিতে হয়। অনেক সময় এমন নবজাতকদের দত্তক নেওয়ার জন্য অনেক নিঃসন্তান বাবা-মা ভিড় করে, শিশুটি নিয়ে যদি জটিলতা না তাকে তাহলে তাদেকে দেওয়া যেতে পারে।
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ ধরণের ঘটনার পেছনে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তবে সেক্ষেত্রে আমাদের কাছে অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরেদের ক্ষেত্রে কে বা কারা অভিযোগ দিতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মানসিক ভারসাম্যহীন নারী এ ধরণের ঘটনার শিকার হলে সমাজসেবা কর্মকর্তারা তাদের পক্ষ নিয়ে অভিযোগ দিতে পারে।
এ্যান্টনি দাস অপু/আরকে