‘প্রত্যেক দিন আব্বুরে দেখতে নদীর পাড়ে আই, কিন্তু দেহি না’
‘প্রত্যেক দিন আব্বুরে দেখতে এই নদীর পাড়ে আই (আসি), কিন্তু আব্বুরে দেহি না। আব্বু কোন সময় আইবে হেই খোঁজে বইয়া থাকি। কিন্তু আব্বুর কোনো খোঁজ পাই না। প্রত্যেক দিন আই সব মানুষেরে দেহি কিন্তু আব্বুরে দেহি না’। এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল নিখোঁজ জেলে আল-আমিন বিশ্বাসের ১২ বছরের মেয়ে মারিয়া। পাশেই বাবার অপেক্ষায় নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার ছোট ভাই আব্দুল্লাহ।
একটু পরেই বাবা ফিরবে, এমন আশা নিয়ে বাড়ির পাশের নদীর ঘাটে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা ছুটে বেড়ায় শিশু মারিয়া ও আব্দুল্লাহ।
বিজ্ঞাপন
মারিয়া বলে, ‘স্কুলে যাইতে এহন আর ভালো লাগে না। বড় কাকার ধারে যে সময় যা চাইছি হেই সময় হেইয়াই দেছে, আল্লাহ তুমি হেগো বাঁচাইয়া রাইখো।’
বাবা বেঁচে ফিরে আসবেন, কোলে তুলে নিয়ে আদর করে আবদার মিটিয়ে একসঙ্গে খেতে বসবেন। অপেক্ষার পালা যেন শেষ হয় না, সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। ক্লান্ত সন্ধ্যায় বুকে চাপা কান্না নিয়ে প্রতিদিন বাড়ি ফিরেন নিখোঁজ জেলে আল আমিন বিশ্বাসের দুই শিশু সন্তান।
বিজ্ঞাপন
মারিয়া ও আব্দুল্লাহর মতো কেউ হারিয়েছেন বাবা, কেউ সন্তান কিংবা স্বামী। নিখোঁজ জেলেরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কবে ফিরবেন স্বজনদের এ প্রশ্ন ও আহাজারিতে আকাশ ভারী হয়ে আছে বরগুনা সদর উপজেলার ৭ নম্বর ঢলুয়া ইউনিয়নের দুই গ্রাম। ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র সময় সমুদ্রে নিখোঁজ হন ২৫ জন জেলে। এদের মধ্যে বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের মঠখালী গ্রামের বাসিন্দা ৪ জন। বাকি ২১ জেলেও বরগুনা সদর উপজেলা ও পাথারঘাটা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা।
মঠখালী গ্রামের নিখোঁজ জেলে আউয়াল বিশ্বাস ও তার আপন ভাই আল-আমিন বিশ্বাসের বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, দুই স্বজন নিখোঁজের ঘটনায় তাদের পরিবারে চলছে আহাজারি। ১৭ নভেম্বরের পর থেকে নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধান পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্বজনরা। নিখোঁজ জেলেরা বেঁচে আছেন, ভালো আছেন এমন সংবাদের অপেক্ষায় পরিবারগুলো।
নিখোঁজ দুই ভাই আউয়াল বিশ্বাস ও আল-আমিন বিশ্বাসের মা বিলকিস বেগম বলেন, আমার বড় ছেলে ও মেজো ছেলে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। বৃহস্পতিবার ঘূর্ণিঝড়ের আগে সন্ধ্যার দিকে তাদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। ওই সময় তাদের থেকে জানতে পারি- সাগরের আবহাওয়া খুব খারাপ। এ সময় তাদেরকে সতর্ক থেকে সাবধানে থাকতে বলেছি। পরে তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারিনি।
ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব মুহূর্তে সাগরে কি অবস্থায় ছিল জেলেরা সে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আউয়াল বিশ্বাসের স্ত্রী নার্গিস বেগম বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাগরে অবস্থানরত অবস্থায় আমার স্বামী মোবাইল ফোনে জানান, সাগরে আবহাওয়া অনেক খারাপ। ট্রলারের চারপাশে কিছুই দেখছেন না। এরপর থেকে তার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।
নিখোঁজ জেলে আউয়াল ও আল-আমীনের ভাই হায়দার বিশ্বাস বলেন, আমার আপন দুই ভাইসহ এই গ্রামের ৮ জন নিখোঁজ রয়েছে। তাদের পরিবারগুলো এখন অসহায় অবস্থায় রয়েছে। তাদের ঘরে চাল, ডাল এমনকি কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য টাকাও নেই। আমার ভাইয়ের মেয়ের পরীক্ষার ফি দিয়েছি গ্রামের সবাই মিলে। উদ্ধার অভিযানে নিয়োজিত কোস্টগার্ড অথবা প্রশাসনের কেউ নিখোঁজ জেলেদের সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেনি।
এ বিষয়ে ওই এলাকার ইউপি সদস্য গোলাম ফরিদ বলেন, মঠখালী গ্রামের ৮ জন জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। এদের মধ্যে এক বাড়ির আপন দুই ভাইসহ পাশের গ্রামেও নিখোঁজ জেলে রয়েছেন অনেকেই। নিখোঁজ জেলেদের পরিবারের আয়ের একমাত্র ভরসা এই জেলেরাই। নদীতে বা সাগরে মাছ পেলেই এসব জেলেদের সংসার চলে। এতে তাদের পরিবারগুলো অসহায় হয়ে পড়েছেন।
এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, নিহত বা আহত জেলেদের ক্ষতিপূরণের নির্দেশিকা অনুযায়ী আমরা তাদের স্বপক্ষে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে থাকি। পরবর্তীতে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য বরাদ্দকৃত নগদ টাকাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এছাড়া আপৎকালীন সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের ক্ষতিপূরণে স্থানীয় প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক কিছু সহযোগিতা করা হয়।
এএএ