পাঁচ বছর আগে তার নিজের নামে এক টাকাও ছিল না। কিন্তু এখন তিনি রানির হালে! বর্তমানে তিনি সোয়া কোটি টাকার মালিক। রয়েছে ১ হাজার বর্গফুটের একটি দালানও। যার দাম ১ কোটি ১ লাখ টাকার ওপরে। শূন্য থেকে কোটিপতি হওয়া সম্ভব হয়েছে তার স্বামী বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ার সুবাদে। পাঁচ বছর আগে একটি গহনা না থাকা এই নারী এখন গাড়ি-বাড়ির মালিক। তার স্বামী বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনে সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু ওরফে শওকত আলী গোলবাগী।

পরিবর্তন যে বাবলুর স্ত্রী শুধু হয়েছে তা নয়, এই হাওয়া বদলে দিয়েছে এই এমপির অর্থনৈতিক অবস্থাও। পাঁচ বছর আগে বাবলু হলফনামায় উল্লেখ করেছিলেন, তার বার্ষিক আয় ৫ হাজার টাকা। ভোটে দাঁড়ানোর আগে জমা টাকা ছিল ৩০ হাজার। চলাফেরা করতেন একটি পুরোনো মোটরসাইকেলে।

তবে এখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বর্তমানে তিনি দুটি গাড়িতে চড়েন। একটি নিশান এক্সট্রেইল জিপ। অন্যটি ল্যান্ডক্রুজার। দুটির দাম এক কোটি ৪ লাখ ৪৫ হাজার। সব মিলে বর্তমানে তার সম্পদ ১ কোটি ৬৪ লাখ ৩৯ হাজার ৩৩৫ টাকা।

এসএসসি পাস বাবলু দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে কমিশনে দেওয়া হলফনামায় নিজের পেশা ইট, বালু, সিমেন্টসহ অনলাইন ব্যবসা উল্লেখ করেছেন। একাদশে জমা দেওয়া হলফনামায় তার পেশা লেখা ছিল ব্যবসা ও সাংবাদিকতা।

তখন তার বার্ষিক আয় ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ এমপি হওয়ার আগ পর্যন্ত তার মাসিক আয় ছিল ৪১৭ টাকা। বর্তমানে তার ও তার ওপর নির্ভরশীল বার্ষিক আয় ৩৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৩৫ টাকা। অর্থাৎ এখন তার মাসে আয় তিন লাখ ২ হাজার ২৮ টাকা। এই হিসেবে আয় বেড়েছে ৭২৪ গুনের বেশি।

পাঁচ বছর আগে বাবলুর হলফনামায় আয়ের উৎস বলা হয়েছিল কৃষি ও ব্যবসা। এর মধ্যে কৃষি খাত থেকে বছরে আসে ৩ হাজার টাকা। আর ব্যবসা থেকে বছরে আয় ২ হাজার টাকা। নির্বাচনের আগে তার কাছে নগদ টাকা ছিল ৩০ হাজার। ব্যাংকে জমার পরিমাণও ৩০ হাজার টাকা। তার মোটরসাইকেলের মূল্য ৫০ হাজার টাকা উল্লেখ ছিল।

তবে এবার জমা দেওয়া হলফনামা বলছে ভিন্ন কথা। এবার কৃষি খাতে তার কোনো আয় নেই। বাড়ি ভাড়া থেকে পান ১ লাখ ৮০ হাজার। ইট, বালু, সিমেন্ট ও অনলাইন ব্যবসা থেকে বছরে আয় ১১ লাখ ১৫ হাজার টাক। এমপি হিসিবে প্রাপ্ত আয় ও আনুতোষিক ২৩ লাখ ২৪ হাজার ২২৫ টাকা।

পাঁচ বছর আগে তার নগদ টাকা ছিল ৩০ হাজার। বর্তমানে তার নিজ নামে সাড়ে পাঁচ লাখ আছে। ব্যাংকে ছিল ৩০ হাজার। এবার অবশ্য ব্যাংকে তার কোনো টাকা নেই। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে তার ৫০ হাজার টাকা দামের গাড়ি ছিল। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তিনি এক কোটি ৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দামের দুটি বিলাসবহুল জিপ গাড়ি ব্যবহার করেন।

পাঁচ বছর আগে বাবলুর কাছে ৬ ভরি স্বর্ণ ছিল। তবে এবার তার কাছে কোনো স্বর্ণ নেই। কিন্তু তার স্ত্রী বৈবাহিক সূত্রে ১০ ভরি স্বর্ণ পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রীর নামে এই স্বর্ণের কোনো তথ্য তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেননি।

পাঁচ বছর সংসদ সদস্য বাবলুর ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এবার এখানে তার কোনো পরির্তন হয়নি। পাঁচ বছর আগে তার আসবাবপত্র ছিল দেড় লাখ টাকার। এবারও এই সম্পদের পরিমাণ একই বলে হলফনামায় তুলে ধরা হয়েছে।

পাঁচ বছর আগে অন্যান্য খাতে রেজাউল করিম বাবলু টাকা ছিল ৩০ হাজার। এবার অন্যান্য খাতে কিছু উল্লেখ করেননি। স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে পাঁচ বছর আগে তার কৃষি জমির পরিমাণ ছিল ৪৫ শতক। এবার তিনি কৃষি জমির কথা উল্লেখ করেননি। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে তিনি অকৃষি জমির আর্থিক মূল্য উল্লেখ করেছিলেন ৪৫ লাখ টাকা। এবারের হলফনামায় তিনি বলেছেন তার ৩৫ হাজার টাকা মূল্যের অকৃষি জমি রয়েছে।

পাঁচ বছর আগে নিজের নামে বাবলুর ৫ লাখ টাকার দালান ছিল। এবার অবশ্য সে দালানের কোনো হদিস নেই হলফনামায়। কিন্তু গণেশ উল্টে তার স্ত্রী নামে ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার আবাসিক ভবন থাকার কথা বলেছেন হলফনামায়। পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রী নামে কোনো আবাসিক দালান ছিল না।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে রেজাউল করিম গোলবাগীর কোনো বাড়ি বা এপার্টমেন্ট ছিল না। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য জমা দেওয়া হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেছেন তার নামে ১৫ লাখ টাকার একটি এপার্টমেন্ট রয়েছে।

পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রীর নামে কোনো সম্পদ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে তিনি নগদ ২ লাখ ৫০ টাকার মালিক। আছে তিন লাখ টাকার মূল্যের একটি মোটরসাইকেল। ১০ ভড়ি স্বর্ণেরও মালিক তিনি। যদিও পাঁচ বছর আগে তার নামে এক আনা স্বর্ণের কথাও উল্লেখ ছিল না।

সোমবার (৪ ডিসেম্বর) বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বগুড়া জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রার্থিতা বাছাইয়ে আসেন রেজাউল করিম বাবলু। এ সময় স্ত্রীর আয়ের উৎস সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার আয়-ব্যয়ের সব হিসাবের ব্যাখ্যা মনোনয়নপত্রের ফাইলে দেওয়া আছে। আপনারা সব সেখানেই পাবেন। আমার কিছু বলার নেই।

যেভাবে এমপি হলেন রেজাউল করিম বাবলু
বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনটি ‘জিয়া পরিবারের আসন’ হিসেবে পরিচিত। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান গাবতলী ও পাশের উপজেলা শাজাহানপুর নিয়ে এ আসন গঠিত। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সব জাতীয় নির্বাচনেই এ আসনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

সাজাপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি খালেদা জিয়া। এখানে বিএনপির মনোনয়ন পান দলের গাবতলী উপজেলা শাখার নেতা মোরশেদ মিলটন। তখন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। আসনটি বিএনপিশূন্য হয়ে যায়।
এখানে আওয়ামী লীগেরও প্রার্থী ছিল না। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। তবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বড় অংশ ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থী ফেরদৌস আরা খানের পক্ষে। তিনি গাবতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতির আজম খানের স্ত্রী এবং শহর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক রফি নেওয়াজ খানের শাশুড়ি। এই অবস্থায় ভোটের একদিন আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিমকে সমর্থন দেয় স্থানীয় বিএনপি। ফলে এক রাতের ব্যবধানে সংসদ হন বাবলু।

আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/এসএম