জামালপুর শহরের ফৌজদারী মোড়ের শহর রক্ষা বাঁধ। বাঁধের ঠিক নিচেই ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের ঢালে ছোট্ট ছাপড়া করে পরিবার নিয়ে বাস করছেন লোকমান হোসেন গাদু নামে ষার্টোর্ধ্ব একবৃদ্ধ। তবে তার এ বাসস্থানও দীর্ঘস্থায়ী হয়না। কখনও ব্রহ্মপুত্র নদের এপাড়ে, নয়তো কখনও ওপাড়ে ঠাঁই হয় পরিবার নিয়ে। বর্ষা মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদে মাছ ধরে, জাল বুনে আর শুষ্ক মৌসুমে নদের বুকে ধান চাষ এবং দিনমজুরি করে জীবন ধারণ করছে পরিবারটি।

২৪ বছর আগে আপন বড় ভাইয়ের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজের ভিটে-মাটি থেকে বিতারিত হয়ে জামালপুর শহরে আশ্রয় নিয়েছেন লোকমান হোসেন গাদু। বর্তমানে শহরের ব্রহ্মপুত্র নদের শহর রক্ষা বাঁধের ওপর ঠাঁই তার। অথচ একটা সময় লোকমান হোসেন গাদুর এমন ভাসমান ভবঘুরে পরিবার ছিল না।

জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রাম দুরভিটা এলাকায় সুখি পরিবার ছিল তার। ছিলেন কয়েক বিঘা জমির মালিক। জমি বর্গা দিয়েও বছরে কমপক্ষে ১শ মণ ধান পেতেন। প্রতি বছরই কোরবানি দিতেন। আর চিন্তাভাবনাহীন সুখি লোকমান গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে বেড়াতেন। কিন্তু বড় ভাই আব্দুর রহমানের লোলোভ দৃষ্টিতে লোকমানের সুখকর আন্দময় জীবন বেশিদিন টেকেনি।

তার সরলতা ও অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে বড় ভাই তার ভাগের সমস্ত জমি ছলচাতুরি করে লিখে নেন। তারপর ছোট ভাই লোকমানকে বাড়ি ছাড়া করতে শুরু করেন তার বিরুদ্ধে চুরি, ডাকাতি ও সন্ত্রাসী মামলা। উপায়ন্তর না পেয়ে আত্মরক্ষায় স্ত্রী রোকিয়া, মেয়ে রুবি, সুবি, রূপা ও কোলের শিশু সন্তান রুবেলকে নিয়ে চলে আসেন জামালপুরে। 

সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় জামালপুর এসে প্রথমে দিকে একটু মাথা গোজার ঠাঁই পেতে বিভিন্নস্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কখনও অন্যের বাড়ির বারান্দায়, নয়তো কারো গোয়াল ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। যাজাবর জীবন-যাপন দেখে স্থানীয় একজনের পরামর্শে আশ্রয় নেন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে। শুষ্ক মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদের অপরপ্রান্তে আর বর্ষা মৌসুমে এপ্রান্তে শহর রক্ষা বাঁধের ঢালে ছোট্ট ছাপড়া ঘর তুলে সেখানেই পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছেন। 

এলাকাবাসী জানান, প্রতি বছর বন্যা এলেই বাঁধের ওপরে আশ্রয় নেয় প্রায় শতাধিক বানভাসি পরিবার। আবার বন্যার পানি চলে গেলে তারাও চলে যায় নিজেদের বাড়ি-ঘরে। কিন্তু এ পরিবারটি সবসময় এ বাঁধের ওপরে থেকে যায়। তারা বছরের পর বছর ধরে এখানেই বসবাস করছে। সেইসঙ্গে লালন পালন করছে গরু-ছাগল। তারা নদীতে মাছ ধরে আবার নদীর পাড়েই ধান চাষ করে।কখনও দিনমজুরিও করতে দেখি। কিন্তু কেন তারা এখানে এভাবে জীবন যাপন করছে জানতে চাইলে তারা জানায়, তাদের যাবার আর কোনো জায়গা নেই, তাই এখানেই আশ্রয় নিয়ে থাকছেন তারা।

লোকমান হোসেন গাদু তার এমন জীবনধারণের কারণ সম্পর্কে বলেন, আমার পরিবার একদিন নদীর পাড়ে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটাবে তা কখনও ভাবতে পারিনি। আমি এখানে থাকতেও চাইনা। আমি অসহায় দুর্বল হওয়ার কারণে আমারই আপনজনের লোভের শিকার এবং প্রতারিত হয়ে নিজ বাড়ি থেকে বিতারিত হয়েছি। আমার সহায়-সম্বল আত্মসাৎ করতে আমার বিরুদ্ধে ১১টি মিথ্যা মামলা দিয়েছিলেন আমারই বড় ভাই। তার করা একাধিক মামলার রায় আমার পক্ষেই এসেছে। এ ঘটনার প্রায় ৩ বছর হয়ে গেল, তারপরও আমি আমার বাড়ি ফিরতে পারছি না। অগত্যা নিরুপায় হয়েই আমি এখানে অমানবিক জীবন-যাপন করছি। সরকার আমাকে আমার ন্যায্য প্রাপ্য ফিরে পেতে সহায়তা করলে আমি এমন জীবন-যাপন থেকে মুক্তি পাব।
 
জামালপুর পৌরসভার মেয়র মো. ছানোয়ার হোসেন ছানু জানান, শহর রক্ষা বাঁধে আশ্রয় নেয়া পরিবারটি আমার নজরে এসেছে। পরিবারটি যেহেতু ২৪ বছর ধরে মানবেতন জীবনযাপন করছে তাদের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে আমি অব্যশই উদ্যোগ নেব এবং পৌর মেয়র হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব। 

এমএএস