ব্যবধান মাত্র পাঁচ বছরের। এর মধ্যে কৃষি জমি বেড়েছে ১২০০ গুণ। ১৩১ গুণ বেড়েছে কৃষি আয়ও। বাড়ি ভাড়ায় আয় বেড়েছে ২৩৪ গুণ। পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রীর নগদ অর্থ ছিল দেড় লাখ টাকা। ছিল না কোনো ব্যাংকের হিসাব। ২০২৩ সালে এসে স্ত্রীর নগদ অর্থ ও ব্যাংক হিসাব বেড়েছে ১৪৪ গুণ।  

এতো শুধু দুটি খাতের তথ্য। পুরো সম্পদ বিবরণী বলছে, এমপি ৫ কোটি ২৯ লাখ ৪১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তার সম্পদ বেড়েছে ৫ গুণ। 

স্ত্রীরও আঙুল ফুলে হয়েছেন কলাগাছ। তার সম্পদের পাহাড়ে জমা হয়েছে ২ কোটি ৬২ লাখ ৭ হাজার ১০৩ টাকা। এর মধ্যে নগদ অর্থ ও ব্যাংক হিসাব মিলে আছে ২ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৩০ টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে স্ত্রীর ব্যাংক আমানত ও নগদ অর্থ বেড়েছে অন্তত ১৪৪ গুণ।  
 
আলাদিনের চেরাগ পাওয়া এই এমপির নাম শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ। তিনি বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্য (এমপি) এবং বগুড়া জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি। তার স্ত্রীর নাম মহসিনা আক্তার। দুজনে মিলেমিশে সম্পদের মালিক হয়েছেন। বেড়েছে প্রার্থীর ওপর নির্ভরশীলদের আয়।

২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নির্বাচিত হন। এ ছাড়া মেসার্স ইসলাম ইট প্রস্তুতকারক নামে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামার সঙ্গে এই প্রার্থীর বিগত নির্বাচনের হলফনামাগুলো বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে। 

এবারের হলফনামায় দেখা যায়, কৃষিখাতে জিন্নাহর আয় ২ লাখ ৬১ হাজার ৬৩০ টাকা । অথচ দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় কৃষি খাতে আয় ছিল ২ হাজার টাকা। বাড়ি, দোকান ভাড়া থেকে এখন আয় ৪ লাখ ২০ হাজার ৫০০ টাকা। তবে পাঁচ বছর আগেও এই খাতে আয় ছিল ১ হাজার ৮০০ টাকা। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী হলফনামায় কৃষি খাতে প্রার্থীর ওপর নির্ভরশীলদের আয় দেখানো হয় ২৪ হাজার ৭২০ টাকা। বাড়ি ভাড়া ৬০ হাজার টাকা। যদিও আগে এ খাতে কোনো আয় ছিল না। ব্যবসা খাতে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে জিন্নাহর আয় ছিল ৩ লাখ ১৫ হাজার ৮০০ টাকা। এবার তার ব্যবসা থেকে আয় দেখানো হয় ৭ লাখ টাকা। নির্ভরশীলদের ব্যবসা থেকে আয় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

আর বছরে আয় হিসেবে ব্যাংকে জিন্নাহর আছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭৫৬ টাকা।  নির্ভরশীলদের নামে আছে ৩ লাখ ২৪ হাজার ৪৮০ টাকা। ব্যবসা খাতে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে জিন্নাহর আয় ছিল ৩ লাখ ১৫ হাজার ৮০০ টাকা। এবার তার ব্যবসার আয় দেখানো হয়েছে ৭ লাখ টাকা। আর তার ওপর নির্ভরশীলদের আয় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। 

শেয়ার/সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক আমানত থেকে জিন্নাহর আয় ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭৫৬ টাকা। তার ওপর নির্ভরশীলদের আয় ৩ লাখ ২৪ হাজার ৪৮০ টাকা। পেশা (শিক্ষকতা, চিকিৎসক, আইন, পরামর্শক ও ইত্যাদি) থেকে প্রার্থীর কোনো আয় না থাকলেও তার ওপর নির্ভরশীলদের আয় ৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। 

জিন্নাহর স্ত্রী মহসিনা আক্তার উপজেলার মোকামতলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি বলে জানা গেছে। এর বাইরে তার কোনো পেশার তথ্য কারও জানা নেই। তার বড় ছেলে হুসাইন শরীফ সঞ্চয় বাবার সাথে ব্যবসা করেন। আর ছোট ছেলে তাজবীর শরীফ ঢাকায় থাকেন। 

চাকরি খাতে জিন্নাহর আয় ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। আর সংসদ সদস্য হিসেবে বছরে তার সম্মানী ১৯ লাখ ৩৯ হাজার ৬৭৫ টাকা।

এবারের হলফনামায় জিন্নাহ নিজের ব্যবসায়িক পুঁজি হিসেবে নগদ ৯৭ লাখ ৯৩ হাজার ২৭৬ টাকা দেখিয়েছেন। তার স্ত্রীর নামে রয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ ৮৭ হাজার ১৩৪ টাকা। আর তার ওপর নির্ভরশীলদের নামে দেখানো হয়েছে ৯৩ লাখ ৫৫ হাজার ২৮২ টাকা।

অথচ ২০১৮ সালের হলফনামায় স্ত্রীর নামে নগদ টাকা ছিল মাত্র ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তারও পাঁচ বছর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তার নগদ টাকা দেখানো হয় ৫০ হাজার। 

অস্থাবর সম্পদ হিসেবে ব্যাংকে জিন্নাহর জমা আছে ৭২ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮ টাকা। তার স্ত্রীর ৬২ লাখ ৮৩ হাজার ১৯৬ এবং নির্ভরশীলের আছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৩৫৩ টাকা। 

হলফনামার তথ্য বলছে, ১০ বছর আগে স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা থাকলেও জিন্নাহর নামে কিছু ছিল না। পাঁচ বছরের ব্যবধানে জিন্নাহর ব্যাংকে জমা হয় ৫০ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৭ টাকা। তার পাঁচ বছর পর এবার এই খাতে বেড়েছে ২২ লাখ ৪ হাজার ২৮১ টাকা। 

গত ১০ বছরে জিন্নাহ বা তার স্ত্রীর সঞ্চয়পত্র না থাকলে এবার স্ত্রী মহসিনার নামে ২৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেখানো হয়। এসব হিসাবের বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাঁচ বছরের ব্যবধানে জিন্নাহর স্ত্রীর নগদ ও ব্যাংক আয় বেড়েছে ১৪৪ গুণ। 

১০ বছর আগে জিন্নাহর ৭৭ হাজার টাকার একটি মোটরসাইকেল ছিল। সে সময় স্ত্রীর নামে ৫ লাখ টাকার একটি মোটরগাড়ির কথা উল্লেখ করা হয়। পরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওই মোটরসাইকেলের পাশাপাশি ৩৬ লাখ ৭৪ হাজার ৯১৯ টাকার ল্যান্ড ক্রুজার ছিল। কিন্তু স্ত্রীর নামে কিছু ছিল না।

এবারের হলফনামায় স্বামী-স্ত্রী দুজনের গাড়ির মূল্যমান বেড়েছে। জিন্নাহর নামে ১ কোটি ১ লাখ টাকার একটি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার এবং তার স্ত্রীর নামে ১৫ লাখ ২৫ হাজার টাকার একটি ট্রাকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
জিন্নাহর নামে ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ৩০ তোলা স্বর্ণ রয়েছে। স্ত্রীর রয়েছে ৪০ তোলা পরিমাণ ২ লাখ টাকার স্বর্ণ। জিন্নাহর নামে কোনো ইলেকট্রনিক সামগ্রী না থাকলেও ৮০ হাজার টাকার আসবাবপত্র আছে। তবে এই দুই খাতে মোট ২ লাখ টাকার সম্পত্তি রয়েছে তার স্ত্রীর নামে। গত ১০ বছরে তার স্ত্রীর নামে এই সম্পত্তিগুলো বেড়েছে।

পাঁচ বছর আগে জিন্নাহ অস্থাবর সম্পত্তির অন্যান্য খাতে আড়াই লাখ মূল্যের একটি পিস্তল ও মিনি রাইফেলের কথা জানিয়েছিলেন হলফনামায়।  কিন্তু দ্বাদশ নির্বাচনে এই খাতে তার অস্ত্র দুটির কথা উল্লেখ করেননি জিন্নাহ। পাঁচ বছরের ব্যবধানে এ খাতে এবার ১৮ লাখ ৬১ হাজার ৬৭২ টাকা ব্যবসার স্থায়ী বিনিয়োগ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। 

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী হলফনামায় জিন্নাহর ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার টাকার ১৪০ শতক কৃষি জমি। অকৃষি জমির মূল্য ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার একটি টিনশেড কাঁচা পাকা বাড়ি ও ৮০ হাজার টাকার পুকুর। তার স্ত্রীর ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা মূল্যের ৭ শতকের কৃষি জমি, ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকার ৭ শতক জমির ওপর নির্মিত বাড়ি।

একাদশ সংসদ নির্বাচনী হলফনামাতেও স্বামী-স্ত্রীর একই পরিমাণ স্থাবর সম্পদের কথা উল্লেখ ছিল।    
কিন্তু দ্বাদশ নির্বাচনের সময় হলফনামায় এমপি শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর স্থাবর সম্পদে বড় পরিবর্তন দেখা গেছে। এই পরিবর্তন আছে তার স্ত্রীর অংশেও। 

এবারের হলফনামা বলছে, জিন্নাহর ১ দশমিক ৪০ শতক কৃষি জমি বেড়েছে। বর্তমানে তিনি এক হাজার ৬৯৩ দশমিক ২২ শতক কৃষি জমির মালিক। এর মূল্য জানিয়েছেন ৪৫ লাখ ৫০ হাজার ১৫০ টাকা। 
এ কাতারে পিছিয়ে নেই তারও স্ত্রী। মাত্র ৭ শতকের কৃষি জমি বদলে এখন হয়েছে ১৫৬ দশমিক ৮ শতক। মূল্য বলা হয়েছে ২৭ লাখ ১১ হাজার ৮০০ টাকা। 

জিন্নাহর অকৃষির জমির মূল্য দেওয়া আছে ১০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। স্ত্রীর অকৃষি জমি না থাকলেও তাদের নির্ভরশীলদের নামে আছে ১০ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের অকৃষি জমি।

জিন্নাহর নামে ১ কোটি ৮৯ লাখ ৬১ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের দুটি দালান বাড়ি এবং ১৫ লাখ ৯২ হাজার ১৯৫ টাকার একটি ফ্ল্যাট আছে এবারের হলফনামায়। হলফনামায় জিন্নাহ নিজের নামে ২টি ব্যাংক ঋণের কথা জানিয়েছেন। মধুমতি ব্যাংক লিমিটেডের মতিঝিল শাখা থেকে ৫ লাখ ২৮ হাজার এবং রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের মহাস্থানগড় শাখা থেকে ৩০ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের মহাস্থানগড় শাখা থেকে নির্ভরশীলদের নামে ৪৯ লাখ ৪৭ হাজার টাকার ব্যাংক ঋণ দেখানো হয়। 

এছাড়া গত তিন বারের পর এবারই এমপি শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ সম্পূর্ণ নিজের টাকায় নির্বাচনী ব্যয় মেটাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

দুদকের মামলা

সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এমপি শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।

মামলায় ১ কোটি ৫৯ লাখ ৭৮ হাজার ১১৩ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৮৯ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৮ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আছে। ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ কমিশনের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলা দুটির তদন্ত চলছে।

আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/আরএআর