ফাইল ফটো

অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। যে বয়সে স্কুল শেষে বাসায় ফিরে মাঠে খেলা বা নতুন কিছু জানার কৌতুহলে মগ্ন থাকার কথা সেই বয়সে তারা জড়িয়ে পড়ছে মাদক, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণসহ নানা অপরাধে। বিশেষ করে মাদকের ছোবলে পড়ে মাদকাসক্ত হয়ে এক সময় কিশোর বয়সেই হয়ে উঠছে মাদক কারবারি। 

সারাদেশের মতো বরগুনাও বেড়েছে এমন কিশোর অপরাধের সংখ্যা। কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে বরগুনায় স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় সচেতনতামূলক বিট পুলিশিং কর্যক্রম পরিচালনা করছেন জেলা পুলিশ ।

২০১৯ সালে বরগুনায় আলেচিত রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনার পর থেকেই আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয় কিশোর গ্যাং। ওই মামলায় অপ্রাপ্তবয়স্ক ১১ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপরেও সংঘবদ্ধ হয়ে একের পর এক লোমহর্ষক অপরাধে জড়িয়েছে বরগুনার অনেক শিশু ও কিশোররা। যার মধ্যে সবশেষ বরগুনায় আলোচিত হৃদয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে ১৬ কিশোরের। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে মাদকের মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে আটকাদেশ দেওয়া হয়েছে অনেককে। সব মিলিয়ে বরগুনায় গত তিন বছরে মাদক, ধর্ষণ এবং খুনের মতো লোমহর্ষক ঘটনার ৬৯টি মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে আটকাদেশ দেওয়া হয়েছে প্রায় শতাধিক শিশু ও কিশোরকে। যাদের মধ্যে ৩৪ জনকে দেওয়া হয়েছে শিশু আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি।

সমাজ সচেতনরা বলছেন, কিশোর অপরাধ বৃদ্ধিতে পরিবার থেকে সঠিক শিক্ষা না পাওয়াই অন্যতম একটি কারণ। শিশু বয়স থেকে চরিত্র গঠনে অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে হবে। সন্তানের সব ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে একসময় তারা পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরে জড়িয়ে পড়ে নানান ধরনের অপরাধে।

বরগুনা গ্লোবাল ল’থিংকার্স সোসাইটির চিফ অপারেটিং অফিসার অ্যাডভোকেট মাহিন মেহরাব অনিক বলেন, শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের মোবাইল আসক্তি থেকে দূরে রাখতে দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে বিকল্প কিছুর ব্যবস্থা করতে হবে। এর পাশাপশি পর্যাপ্ত পরিমাণ খেলাধুলা নিশ্চিত করলে সমাজ থেকে শিশু কিশোরদের অপরাধ থেকে দূরে রাখা যাবে।

বরগুনা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মতিউর রহমান বলেন, বিপথে যাওয়া কিছু কিছু শিক্ষার্থীরা কলেজে মেধা তালিকায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। তবে তাদের বিপথে যাওয়ার পেছনে বেকার, মাদক এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও কিছুটা দায়ী। তাছাড়া এ ধরনের অপরাধীরা কোনো না কোনো ছত্রছায়ায় এ অপরাধ কর্মকাণ্ডগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে যায়। 

তিনি আরও বলেন, আমাদের একটি টিম আছে যাদের মাধ্যমে আমরা এ ধরনের অপরাধমূলক কাজ যারা করে তাদেরকে চিহ্নিত করি। পরে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশকে অবহিত করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবোর্ডে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লিখিত অভিযোগ দেই।

বরগুনা জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোস্তাাফিজুর রহমান বাবুল বলেন, বর্তমানে শিশুদেরকে যে শিক্ষা দেওয়া হয় তা বাস্তবসম্মত নয়। বিশেষ করে প্রাইমারি যে শিক্ষা ব্যবস্থা তার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। আমাদের দেশে যে শিশুরা অপরাধে জড়ায় তারা বেশিরভাগ গরিব ঘরের ছেলেমেয়ে। শিশু অপরাধের যে মামলাগুলো আমরা পাই তার মধ্যে মাদকের মামলাই বেশি। মাত্র ৫০-১০০ টাকার জন্য বেশিরভাগ গরিব ঘরের শিশু ও কিশোররা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। এ কারণে প্রাইমারি স্কুল থেকে কারিগরি শিক্ষা নিয়ে অন্তত দশম শ্রেণি পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থী যদি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয় তাহলে সে নিজেই একজন উদ্যোক্তা হতে পারবে। শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করে কারিগরি শিক্ষা চালু করতে বর্তমান সরকারের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।

বরগুনা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন বলেন, আমাদরে প্রত্যেকটি ইউনিয়নে একজন বিট অফিসার ও একজন সহকারী বিট অফিসারের সমন্বয়ে বিট পুলিশিং কর্যক্রম চালু রয়েছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে স্কুল কলেজসহ বিভিন্ন পাড়া মহল্লার স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে বিট মিটিংয়ের মধ্যমে সচেতনতামূলক আলোচনা করা হয়। এ সময় শিশু কিশোর থেকে শুরু করে উপস্থিত সবাইকে অপরাধ না করতে সচেতন করা হয়। এছড়া আমাদের ঊর্ধ্বতন অফিসারসহ আমরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে সভা, সমাবেশ ও সেমিনার করে থাকি। তারপরেও যারা কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসি। 

তিনি আরও বলেন, দেশে বর্তমানে কিশোরদের জন্য যে আইন রয়েছে তাতে তাদের জন্য সাজার পরিমাণ কিছুটা কম রয়েছে যাতে একজন শিশু বা একজন কিশোর অপরাধী তার সাজা শেষ করে নিজেকে সংশোধন করে সুন্দর জীবন গড়ার সুযোগ পায়।

আরকে