কোনো টমেটোর গা থেকে সবেমাত্র ফুল পড়েছে; আবার কোনোটির পড়েনি। সবই অপরিপক্ক। পুরো টমেটোর ভেতর-বাইর সবুজ বর্ণের। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য— জমি থেকে তোলার ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এসব টমেটো সবুজ থেকে লালচে বর্ণ ধারণ করে। অর্থাৎ কাঁচা টমেটো পাকায় রূপ নেয়। মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, রাতারাতি কীভাবে এমন হচ্ছে। তাহলে কি ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের ‘বিষ’ খাওয়াচ্ছে ভোক্তাদের?

ব্যবসায়ীদের দাবি, তারা শুধু জমি থেকে টমেটো কিনে খোলানে (খোলা মাঠে প্লাস্টিক-খড় পেতে) রাখেন। এরপরে চুলে দেওয়া শ্যাম্পু স্প্রে করা হয় টমেটো পরিস্কারের জন্য। তারপরে রোদে রাখলে এমনিতেই টমেটোর কালার লাল হয়ে যায়। তারা টমেটোতে ক্ষতিকার হরমোন প্রয়োগের বিষয়টি অস্বীকার করলেও পাশে বোতল পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এছাড়া গোদাগাড়ী উপজেলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে টমেটোতে ক্ষতিকারক হরমোন প্রয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে চাষিরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা অধিক মুনফার জন্য হরমোন প্রয়োগ করে থাকেন। এছাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কথায় উঠে এসেছে হরমোন ব্যবহারের বিষয়টি।

শনিবার (১০ ডিসেম্বর) বিকেলে গোদাগাড়ী উপজেলার গোপালপুরের আশেপাশের এলাকায় এমন হরমোন ব্যবহার করতে দেখা গেছে ব্যবসায়ীদের। এই এলাকায় বিভিন্ন জমি থেকে টমেটো কিনে ব্যবসায়ী শামসুল আলম বাবু খোলানে রাখা হয়েছে। সেখানে ১০ থেকে ১৫ জন শ্রমিক টমেটোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কাজ করছেন। শ্রমিকদের কেউ কেউ টমেটো পরিস্কার করছেন। কেউ কেউ নষ্ট টমেটোগুলো দূরে ফেলে আসছেন। কেউ বা সবুজ থেকে লাল হওয়া টমেটোগুলো আলাদাভাবে একত্রিত করছেন। যে টমেটোগুলো প্রস্তুত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রাক যোগে বিক্রির জন্য। শুধু বাবুর খোলানে নয়, আশেপাশের প্রায় সব খোলানে এমন কর্মযজ্ঞ চলছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবছর রাজশাহী জেলায় টমেটো চাষ হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে শুধু গোদাগাড়ী উপজেলায় টমেটোর চাষ হয়েছে ২ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে। যা উপজেলার হিসেবে সিংহভাগ গোদাগাড়ী উপজেলায় টমেটো চাষ হয়। গেল বছর (২০২২) মৌসুমে ৩ হাজার ১৫ হেক্টর ও ২০২১ সালে ২ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে টমেটোর চাষ হয়েছিল। তবে জেলায় মোট ৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির মধ্যে গোদাগাড়ীর চাষাবাদ বাদ দিলে বাকি থাকা ২০০ হেক্টর সব উপজেলাগুলোতে টমেটোর চাষ হয়েছে।

চাষিদের দাবি, এখন টমেটোর বাজার ও চাহিদা ভালো, বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এই দুই কাজে লাগায় ব্যবসায়ীরা। তারা অপরিপক্ক টমেটো কৃষকের জমি থেকে তুলে নেয়। এরপরে একত্রিত করে ইথিলিন হরমোন স্প্রে করে। এতে করে টমেটো কাঁচা অবস্থায় পেকে যায়। পরে ব্যবসায়ীরা ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে দেয়।

টমেটোতে হরমোন প্রয়োগের বিষয়টি জানতে চাইলে ব্যবসায়ী শামসুল আলম বাবু ঢাকা পোস্টকে জানান, তারা টমেটোতে শ্যাম্পু ছাড়া কিছু দেয় না। শ্যাম্পু দেওয়ার কারণে হিসেবে তিনি বলেন, জমিতে থাকা অবস্থায় টমেটোতে ময়লা-মাটি থাকে। শ্যাম্পু স্প্রে করলে ময়লা-মাটি ধুয়ে যায়। এতে করে টমেটোর সুন্দর রঙ আছে। এরপরে ধানের খড়ের ওপরে বিছিয়ে রোদে রাখলে এক থেকে দেড় দিন পর লাল রঙ চলে আসে। এখানে কোনো ওষুধ (হরমোন) ব্যবহার করা হয় না।

তবে এই খোলানের এক শ্রমিক জানান, কিছু না দিলে কাঁচা টমেটো এমনিতে কীভাবে পাকবে। কি দেয় টমেটোতে এমন কথার উত্তরে তিনি বলেন, আপনারা দেখেন।

উপজেলা কৃষি অফিস বলছে, রাজশাহী জেলার মধ্যে গোদাগাড়ী উপজেলায় সবচেয়ে বেশি টমেটোর চাষ ও উৎপাদন হয়। তাই স্থানীয়ভাবে গোদাগাড়ীতে টমেটোর রাজ্য বলা হয়। সাধারণত আউশ ধান কেটে নেওয়ার পরে টমেটো চাষ শুরু হয়। এই উপজেলায় প্রায় ১৭ থেকে ২০ জাতের টমেটো চাষ হয়। যার মধ্যে বেশির ভাগ হাইব্রিড। তবে অন্য যেকোনো মাঠ ফসলের চেয়ে টমেটো চাষ অত্যন্ত লাভজনক।
 
এই উপজেলায় টমেটো কেনাবেচা হয় ১১০ কোটি টাকার বেশি। টমেটো বিক্রির সঙ্গে সরাসরি কৃষকরা জড়িত। ফলে কৃষকদের কাছে দিন দিন অর্থকরী ফসল হিসেবে রূপ নিয়েছে টমেটো। এছাড়া টমেটো কেনা-বেচাকে কেন্দ্র অস্থায়ীভাবে দুই থেকে আড়াই মাসের জন্য ৮ থেকে ৯ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। টমেটো জমিতে উৎপাদন। আর জমি থেকেই বিক্রি। বিক্রি ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় টমেটো চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা।

গোদাগাড়ী উপজেলার প্রোগ্রাম ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. রাকিব জানায়, গেল ৬ থেকে ৭ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে টমেটোর চাষ হচ্ছে। টমেটো চাষের পর বিক্রি করার সুবিধা রয়েছে। কৃষককে টমেটো হাঁটে নিয়ে যেতে হয় না। ব্যবসায়ীরা জমি থেকেই টমেটো কিনে নেন। এতে অনেক টাকা ও সময় বাঁচে কৃষকের।

গোদাগাড়ীর গোপালপুরের শ্রী বলরাম কর্মকার বলেন, চাষিরা বেশির ভাগ ৬৪২ প্রজাতির টমেটো চাষ করেছে। এছাড়া অনেকেই অন্য জাতের টমেটোও চাষ করেছে। তবে এবছর তুলনামূলক গাছে টমেটো কম। টমেটোর ভালো ফলন হয়নি। তবে এখনও দাম মোটামোটি ভালো আছে।  

উৎপাদন আর দাম নির্ণয়ের বিষয়ে গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, সাধারণত প্রতি হেক্টর জমিতে টমেটোর উৎপাদন ধরা হয় ২৫ মেট্রিক টন। সেই হিসেবে এবছর টমেটো উৎপাদন হচ্ছে ৫৬ হাজার ১২৫ মেট্রিক টন। দামের হিসেবে টমেটোর গড় দাম মূল্য ধরা হয় ২০ টাকা কেজি দরে। এতে মোট দাম দাঁড়ায় ১১২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এবছর ১১২ কোটি ২৫ লাখ টাকার টমেটো কেনা বেচা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
 

টমেটো ব্যবসায়ী শামসুল আলম বাবু আরও জানান, গত ১৫ দিন আগেও টমেটোর বেশি দাম ছিল। এখনও ভালো দাম আছে। তিনি প্রতিদিন এক ট্রাক করে টমেটো পাঠান। তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লায় ট্রাকে করে টমেটো পাঠান। তার দাবি তুলনামূলক ভালো দাম এই বাজারগুলোতে। তাই তিনি সেখানে টমেটো পাঠান। টমেটো কেনা-বেচাকে কেন্দ্র করে অনেক মানুষের কর্ম হয়েছে। এই শ্রমিকরা টমেটো জমি থেকে তোলা। এরপরে পরিবহন। তার পর রৌদে শুকানো ছাড়াও বিভিন্ন কাজে লাগে শ্রমিকরা। তারা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করে।

টমেটো পাকাতে হরমোন ব্যবহারের বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার মরিয়ম আহমেদ ঢাকা পোস্টকে জানান, ব্যবসায়ীরা ইথিলিন হরমোন ব্যবহার করে টমেটো পাকানো জন্য। আমরা টেস্ট করে দেখেছি নর্মালি টমেটোতে এই হরমোন থাকে দশমিক ৯১ পিপিএম। তবে ২ পিপিএম পর্যন্ত স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি নেই। আমরা হরমোন ব্যবহারের পুরোপুরি নিরুৎসাহিত করি। তারপরও তারা (ব্যবসায়ীরা) ব্যবহার করে।

তিনি আরো বলেন, এবছর গোদাগাড়ী উপজেলায় টমেটোর চাষ হয়েছে ২ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টরে টমেটোর উৎপাদন ধরা হয় ২৫ মেট্রিক টন। সেই হিসেবে টমেটো উৎপাদন হবে ৫৬ হাজার ১২৫ মেট্রিক টন। গড় মূল্য ২০ টাকা কেজি হলে দাম দাঁড়ায় ১১২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, টমেটো কেনা-বেচাকে কেন্দ্র অস্থায়ীভাবে ৮ থেকে ৯ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

শাহিনুল আশিক/এসএম