মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার বড় নওপাড়া গ্রামে বাড়ির সীমানায় দেয়াল তুলে এক পরিবারকে ৮ মাস যাবৎ অবরুদ্ধ রাখার অভিযোগ উঠেছে প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে। বাধ্য হয়ে ওই পরিবারের সদস্যের মই বেয়ে সেই দেয়াল পার হয়ে ঘরে যেতে হয়। 

জানা গেছে, শুধু দেয়াল নির্মাণ করেই ক্ষান্ত হননি প্রতিবেশীরা। তারা দেয়ালের ওপর দিয়েছেন ধারালো লোহার করাত। এর ওপর দিয়ে পারাপার হতে গিয়ে অহরহ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে পরিবারটি।

ভুক্তভোগী আমির হোসেন (৫৮) ওই গ্রামের ইমাম আলী শেখের ছেলে। ইমাম আলী শেখ গত ৮ বছর আগে মারা যান। আমির হোসেন তার স্ত্রী মালা বেগম, দুই ছেলে মেহেদি হাসান ও উৎসব, মেহেদি হাসানের স্ত্রী কাজল বেগম ও একমাত্র নাতি মোস্তফাকে নিয়ে বাবার রেখে যাওয়া বাড়িতে বসবাস করছেন। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বড় নওপাড়া গ্রামে ২ শতাংশ জমির ওপর ঘর তুলে বসবাস করছেন আমির হোসেন ও তার পরিবার। আমির হোসেনের পরিবারে স্ত্রী, দুই ছেলে, এক ছেলের বৌ ও এক নাতি মিলে মোট ৬ জন সদস্য। ওই বাড়িটির পশ্চিম পাশে ঘর তুলে আগে থেকে বসবাস করছে আরেকটি পরিবার। এক বছর আগে আমির হোসেনের বাড়ির পূর্ব ও উত্তর পাশে সীমানায় দেয়াল নির্মাণ করেন প্রতিবেশীরা। কিন্তু আমির হোসেন আগে থেকেই বাড়ির দক্ষিণ পাশের রাস্তা দিয়ে চলাচল করায় ওই দেয়ালের প্রভাব পড়েনি তাদের যাতায়াতে। 

গত এপ্রিল মাসে দক্ষিণ পাশে সীমানায় দেয়াল নির্মাণ করে তাদের যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ করে দেন প্রতিবেশী রতন মাস্টার, রঞ্জু মোল্লা ও শাহাবুদ্দিন। তাদের দাবি, আমির হোসেনের যাতায়াতের রাস্তার জমিটুকু তারা ক্রয় করেছেন। তাই সীমানায় দেয়াল দিয়ে, তার ওপরে ব্যবহার করেছেন ধারালো লোহার করাত। যাতে দেয়াল টপকে যাতায়াত করতে না পারে আমির হোসেন ও তার পরিবারের কেউ। তারপরেও বাধ্য হয়ে ভুক্তভোগীরা মই দিয়ে ওই দেয়াল টপকে যাতায়াত করছেন।

জানা গেছে, আমির হোসেনের ঘরের পশ্চিম পাশে সৈয়দ ব্যাপারী, মানিক ব্যাপারী ঘর তুলে অনেক আগে থেকেই বসবাস করে আসছেন। ওই পশ্চিম পাশ ছাড়া বাড়ির তিন পাশ খোলা ছিল। কিন্তু গত এক বছর আগে পূর্ব পাশে রতন মাস্টার দেয়াল তুলে রাস্তাটি বন্ধ করে দেন। রতন মাস্টার দেয়াল তোলার সাত দিন পরেই উত্তর অংশে আবু বক্কর সিদ্দিক দেয়াল তুললে আমির হোসেনের বাড়ির দুই অংশ বন্ধ হয়ে যায়। শুধু দক্ষিণ পাশে অংশটা ফাঁকা ছিল। ওই পাশ দিয়েই যাতায়াত করতেন আমির হোসেন ও তার পরিবারের লোকজন। 

কিন্তু গত ৮ এপ্রিল প্রতিবেশী রতন মাস্টার, স্থানীয় লৌহজং তেউটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য রঞ্জু মোল্লা ও শাহাবুদ্দিন তিনজন মিলে দক্ষিণ পাশের ফাঁকা স্থানটিতেও দেয়াল তুলে বন্ধ করে দেন। এতে পুরো পরিবারটি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। 

দেয়ালের ওপরে ধারালো লোহা করাত দিয়ে দিয়েছেন প্রতিবেশীরা। যাতে দেয়াল দিয়ে কেউ যাতায়াত করতে না পারে। ফলে বিপাকে পড়েছেন আমির হোসেন ও তার পুরো পরিবার। সে এবং তার ছেলেরা কোনো রকম মই দিয়ে দেয়াল পারাপার হতে পারলেও ছেলের বৌ কাজল বেগম নাতি মোস্তফা কোনোভাবেই পারাপার হতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে ছেলের বৌ কাজল বেগম ও নাতি মোস্তফাকে ছেলের শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। 

আমির হোসেন বলেন, আমি পৈত্রিক সূত্রে ২৩ শতাংশ জমির মালিক। কিন্তু আমি আমার বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় জোর করে আমার প্রতিবেশীরা অনেকেই আমার জমি দখল করে রেখেছে। আমার বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় সাত্তার মোল্লা নামের এক ব্যক্তিকে আমাগো বাড়ির পাশের কিছু অংশ ভাড়া দিয়েছিল। আমার বাবা মরার পরে রতন মাস্টার, শাহাবুদ্দিন, রঞ্জু মোল্লা বলে তারা এই জমি কিনে নিছে। আমার বাবার ভাড়া দেওয়া জায়গা তারা জোর করে দখল করে নেয় এবং আমাদের ঘর থেকে বের হওয়ার রাস্তায় দেয়াল তুলে দেয়। যখন আমার ঘরের পাশে দেয়াল তুলছিল তখন আমি থানায় যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওরা আমাকে আটকে রাখে। পরে আমি ৯৯৯ এ কল দেই। থানা থেকে পুলিশ এসে কাজ বন্ধ করে দিয়ে যায়। পরে মঞ্জু শেখ থানার আদেশ অমান্য করে দেয়াল নির্মাণ করে ফেলে। এখন মই দিয়ে দেয়াল টপকে বাইরে বের হতে হয়।

আমির হোসেনের স্ত্রী মালা বেগম বলেন, আমি হার্ট ও ডায়াবেটিসের রোগী। ডাক্তার আমাকে দু’বেলা হাঁটতে বলছে। কিন্তু কীভাবে হাঁটব? আমার ঘরের সামনে উঠানে এক শতাংশ জায়গাও নেই আর বাড়ি থেকে বাইরে যাওয়ার রাস্তায় দেয়াল তুলে রাখছে। আমি হার্টের রোগী। এত উঁচু দেয়াল মই দিয়ে উঠতে আমার কষ্ট হয়।

ভুক্তভোগীর বোন রসনা বেগম বলেন, আমার ভাইরে আপনারা একটু মুক্ত করে দেন। আমার ভাইরে ৮ মাস যাবৎ বন্দি করে রাখছে ওরা। এভাবে কী কোনো মানুষ থাকতে পারে? আমার বাবা এই জায়গার কষ্ট নিয়ে মইরা গেছে। এখন ভাইডারে আটকায় রাখছে। আমরা লজ্জায় মানুষরে মুখ দেখাইতে পারি না। আমাদের বাড়ি হতে বের হওয়ার রাস্তা নাই।

প্রতিবেশী মাকসুদা বেগম বলেন, ৬-৭ মাস যাবৎ এদের দেয়াল দিয়ে আটকে রাখছে। এদের মইয়ের ওপর দিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে অনেক কষ্ট হয়। 

এ ব্যাপারে লৌহজং তেউটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য অভিযুক্ত রঞ্জু মোল্লা বলেন, আমির হোসেন তার বাড়ির রাস্তার জমিটুকু বিক্রি করে দিয়েছেন। এ নিয়ে আমাদের চেয়ারম্যানের কাছেও বিচার সালিশ হয়েছে।

ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, আমির হোসেন যেখানে বসবাস করে ওই স্থানটি ঘন বসতিপূর্ণ। ওই স্থানে সবারই ছোট ছোট বাড়ি রয়েছে। আমি আমির হোসেনসহ আশপাশের মানুষ জন নিয়ে বসে ওই স্থানে বসবাসরত সবার যাতায়াতের জন্য রাস্তা রেখে জমি বাটোয়ারা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমির হোসেনকে যে স্থান দিয়ে রাস্তা দেওয়া হয়েছে সে সেই স্থানটিও সে বিক্রি করে দিয়েছে। তারপরও মানবিক কারণে আমি আমির হোসেনকে বাড়ি হতে বের হওয়ার জন্য রাস্তা দিতে ওই এলাকার মানুষজনকে বলে এসেছি।

লৌহজং থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খোন্দকার ইমাম হোসেন বলেন, পুলিশ ওই খানে গিয়েছিল। আমির হোসেনের যে রাস্তার জায়গা ছিল সে সেটুকু বিক্রি করে ফেলেছে। পরে আমরা স্থানীয়দের চেয়ারম্যানসহ জন-প্রতিনিধিদের নিয়ে বসে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করি। কিন্তু আমির হোসেন নিজেই সমাধান মানছেন না।  

ব.ম শামীম/আরকে