শহীদ মজিবর রহমান কাঞ্চনের ছেলে শফিউর রহমান জামাল

‘আমরা তখন বুঝতেই পারিনি ওটাই বাবার সাথে আমাদের শেষ দেখা। আব্বা আমাদের দুই ভাইকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কিছু কথা বললেন। আমাদেরকে টর্চার সেল থেকে বাইরে নিয়ে আসা হলো। আর বাবাকে ৩০-৩৫ জন মিলিটারি নিয়ে গেল টর্চার সেলের ভেতরে।’

কথাগুলো বলছিলেন শহীদ মজিবর রহমান কাঞ্চনের ছেলে শফিউর রহমান জামাল। মজিবর রহমান কাঞ্চনকে এলাকার মানুষ ডাকতেন বাঘা কাঞ্চন নামে। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডাকতেন ধলা কাঞ্চন বা পাগলা বলে। তৎকালীন বরিশাল শহর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কাঞ্চন। পেশায় নামকরা ঠিকাদার।

গবেষক সুশান্ত ঘোষ মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী সকল শহীদদের ত্যাগ সর্বোচ্চ। এর মধ্যে শহীদ মজিবুর রহমান কাঞ্চনের প্রাণ বিসর্জন আরও বেশি অবিস্মরণীয়। তিনি চাইলে টর্চার সেলে স্বেচ্ছায় গিয়ে ধরা নাও দিতে পারতেন। কিন্তু দুই সন্তানকে বাঁচাতে নিজেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান। এমন ঘটনা দৃষ্টান্ত।

১৯৭১ সালে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াপদা কলোনী মিলিটারিদের ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার হতো। ১২-১৩টি ভবনে মিলিটারির পাশাপাশি আল-বদর, আল শামস অবস্থান করতো। এখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙালি, মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ কর্মী ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অর্বণনীয় নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হতো। আর যেসব নারীদের ধরে আনা হতো তাদের যৌন নিপীড়ন করা হতো নিয়মিত। রাত গভীর হলে সেই আর্তনাদ, গোঙানি গগনবিদারী হয়ে উঠতো।

শফিউর রহমান জামাল বলেন, আমরা তখন খুব ছোট। আমি বিএম স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে আর আমার বড় ভাই মশিউর রহমান কামাল জিলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়তো। আব্বা প্রায়ই বলতেন তিনি দেশের বাইরে (ইন্ডিয়া) চলে যাবেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরবেন।

যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পরে অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেলেও আব্বা বরিশাল ছেড়ে যাননি। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত করতে কাজ করছিলেন। বরিশাল শহর দখলের পূর্ব পর্যন্ত তিনি শহরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ব্রজমোহন স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ২৫ এপ্রিল ঝুনাহার প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ওই দিন মিলিটারিরা বরিশাল শহরে ঢুকে পরে দখলে নেন। তারা স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের পর মিলিটারিরা রাজাকারদের সহায়তায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকেন। কৌশলগত কারণে এমএনএ, এমপিএ এবং নেতৃবৃন্দ আত্মগোপন করলেও বাবা গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য বরিশাল ছেড়ে যাননি।

জামাল বলেন, আব্বাকে ধরার জন্য ৮ মে রাজাকারদের সহায়তায় রাত দেড়টার দিকে ক্যাপ্টেন জামিলের নেতৃত্বে একটি দল আমাদের কালিশ চন্দ্র রোডের বাসা তল্লাশি করে। আব্বা অভিযানের কথা আন্দাজ করতে পেরে আমাদের বাসার পেছনে আরেকটি পরিত্যাক্ত ভবনে পালিয়ে ছিলেন। দেশ আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই আব্বা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন কখনো মিলিটারি বা রাজাকার খুঁজতে আসলে যেন বলে দেই তিনি বাসায় নেই, খেপুপাড়া গেছেন।

তিনি বলেন, একটি কথা বলে রাখা উচিত আমরা ৭ ভাই একবোন। যেদিন আমাদের বাসায় অভিযান চালায় সেদিন ছোট ভাইয়ের বয়স ছিল ১৭ দিন। আব্বাকে না পেয়ে মিলিটারিরা আমাকে ও আমার বড় ভাই মশিউর রহমান কামালকে ধরে ওয়াপদা টর্চার সেলে নিয়ে আসে। বাসায় বলে আসে, আব্বা ধরা দিলে আমাদের দুই ভাইকে ছেড়ে দেবে। মিলিটারিরা যখন আমাদের হাত বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল তখন বারবার জানতে চাইছিল, ‘তুমহারা ওয়ালিদ কিধার হ্যায়?’ মানে তোমার বাবা কোথায়? আমরাও বাবার শিখিয়ে দেওয়া কথা বলছিলাম, আব্বা খেপুপাড়া গেছেন।

এভাবে জিজ্ঞাসাবাদের নামে দুইদিন আমাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চললো টর্চার সেলে। ওদিকে মজিবুর রহমান কাঞ্চন যেন মিলিটারির হাতে আত্মসমর্পণ করেন সেজন্য শহরে মাইকিং করানো হচ্ছিল। পরে মা বলেছেন- আমাদের আব্বা আমাদের দুই ভাইয়ের মায়ায় সিদ্ধান্ত নেন তিনি আত্মসমর্পণ করবেন। সে অনুসারে ১১ মে সকালে মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে বাসায় মৌলভী ডেকে তওবা করেন। এরপর বড়ই পাতা গরম জলে দিয়ে গোসল করে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে পরিবারের সকলের সঙ্গে একত্রে নাস্তা করেন। নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে আব্বা পরিবারের সকলকে নিয়ে রিকশাযোগে ওয়াপদা ক্যাম্পে হাজির হন। সেখানে তিনি গিয়ে বলেন, ‘আমি বাঘা কাঞ্চন এসেছি, তোমরা কী করবে করো। আর আমার দুই সন্তানকে ছেড়ে দাও। ওদেরকে ওদের মায়ের কাছে যেতে দাও।’

জামাল বলেন, আমরাতো ক্যাম্পের মধ্যে ছিলাম। জানতাম না বাইরে কী হচ্ছে। হঠাৎ শুনি ক্যাম্পোর সৈন্যদের মধ্যে  শোরগোল। সবাই বলাবলি করছে, ‘বাঘা কাঞ্চন আগায়া।’ আমাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না। ঠিক তার কিছুক্ষণ পর ৩০-৩৫ জন সৈন্য আব্বাকে নিয়ে আসলো আমাদের যে রুমে বন্দী রাখা হয়েছে তার দরজার সামনে। আব্বাকে দেখে আমরা আপ্লুত হয়ে পড়ি। আব্বা আমাদের দুই ভাইকে দুই হাতের বাঁধনে বুকের সাথে আলিঙ্গন করেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা মায়ের কাছে যাও। তাকে নিয়ে বেঁচে থেকো। তোমরাতো ছোট, তারপরও যদি কোনো দিন সম্ভব হয় দেশের জন্য কাজ করো। মনে রাখবা, দেশটা একদিন স্বাধীন হবেই।’

এরপর মিলিটারি আমাদের দুজনকে গেটের কাছে নিয়ে আসে। আর আব্বাকে ক্যাম্পের মধ্যে টর্চার সেলের দিকে নিয়ে যায়। ওটাই ছিল শেষ দেখা। আমরা তখন ছোট বলে সেই অনুভূতিটা তখন বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু তখনো জানতাম না আব্বার সাথে কী হতে যাচ্ছে।

ওয়াপদা কলোনীর বাসিন্দা ফিরু বেগম বলেন, কাঞ্চনকে গুলি করে হত্যা করা হলো ১৩ মে দুপুরের পর। তাকে যখন নির্যাতন চালিয়ে আমাদের বাসার সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন ক্যাম্পে খুব উত্তেজনা চলছিল। কাঞ্চনকে আটকে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল মিলিটারিদের। ৩-৪ জনে শক্ত করে ধরে যেখানে গুলি করবে সেই ব্রিজটির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা সেদিন ছাদে ছিলাম। তাকে আমাদের বাসার সামনে দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার ৪-৫ মিনিট পরে বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ ভেসে আসে। এরপরের দিন ১৪ মে রাতে সাগরদী খালে ভাসতে ভাসতে গিয়ে সাগরদি বাজারের ওখানে আটকে যায় কাঞ্চনের লাশ। সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে মুসলিম গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে বলে শুনেছি।

জানা গেছে, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান কাঞ্চন ১৯৩২ সালে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আহছান উদ্দিন আহেমদ এবং মায়ের নাম তকদিরুন্নেছা। বাবার পেশকারের চাকরির সুবাদে তারা বরিশাল শহরের ব্রজমোহন স্কুলের সামনে কালিশ চন্দ্র রোডে স্থায়ী বাসিন্দা হন। তিনি ব্রজমোহন স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ব্রজমোহন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন। ছাত্র অবস্থায় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। 

একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড় এবং সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে তার বিশেষ পরিচিতি ছিল। কলেজে পড়াশোনাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি নেন। কিন্তু বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণ তাকে ক্ষুব্ধ করে। একপর্যায়ে চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি ১৯৬০ এবং ১৯৬৮ সালে বরিশাল পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান কাঞ্চন স্মরণে ব্রজমোহন স্কুল সংলগ্ন এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ কাঞ্চন পার্ক। অমৃত লাল দে সড়ক এবং কালিবাড়ী রোডের সংযোগ সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান কাঞ্চন সড়ক।##

আরএআর