আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নৌকা মার্কা স্বাধীনতা দিয়েছে। নৌকা হলো নূহ নবীর নৌকা। এই নৌকা মহাপ্লাবন থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করেছিল। এই নৌকা আমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিয়েছে। এই নৌকাই দেবে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ। আমি আপনাদের এলাকার (পীরগঞ্জের) পুত্রবধূ। কী বাহে একখান ভোট মুই পামু না? হামাক একখান ভোট দিবা না?

মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) বিকেলে নিজের শ্বশুরবাড়ি এলাকা রংপুরের পীরগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নির্বাচনী জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মেয়ে শিরীন শারমিন চৌধুরীকে (স্পিকার) আপনাদের দিয়ে গেলাম। তাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করা মানে আমাকে ভোট দেওয়া, জয়কে ভোট দেওয়া। সে জয়ের বোন, পুতুলের বোন। ওয়াদা করেন, নৌকায় ভোট দেবেন। নির্বাচিত হলে আমি আবার আসব, এই মাঠেই আবার জনসভা হবে। 

শেখ হাসিনা বলেন, মানুষের জন্য আমরা রাজনীতি করি। মানুষকে হত্যা করে, খুন করে কী আন্দোলন সেটাই আমরা প্রশ্ন। তরুণ সমাজ, ছাত্রসমাজসহ প্রত্যেককে সজাগ থাকতে হবে। যারা অগ্নিসন্ত্রাস করে তাদেরকে ধরে আগে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করতে হবে। মানুষের জীবন নিয়ে কাউকে আর খেলতে দেব না। আমরা মানুষের কল্যাণে কাজ করি। দিনরাত পরিশ্রম করে এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করছি। সেখানে তারা আসছে ধ্বংস করার জন্য।

নাশকতা সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে সজাগ হতে হবে, সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে বাড়ির কাছে রেললাইন থাকলে পাহারা দিতে হবে। বাসে কেউ আগুন দিতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ধরতে হবে। জনগণকে এটা প্রতিরোধ করতে হবে। ২০১৪ সালে জনগণ এ ধরনের অগ্নিসন্ত্রাস প্রতিরোধ করে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিল, আমরা সরকারে এসেছি। এই অগ্নিসন্ত্রাস রুখতে সকলকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।  

তিনি আরও বলেন, আজকে আপনাদের কাছে এসেছি কারণ সামনে নির্বাচন। এর মাঝে ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমরা জয়লাভ করেছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম ধারাবাহিকভাবে গণতন্ত্র অব্যাহত রেখেছি। একটা স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই স্থিতিশীলতা অনেকে চায় না। যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীর পকেট থেকে দল হয়ে এসেছে, তারা মানুষের শান্তি দেখতে পারে না।

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, রংপুরও অগ্নিসন্ত্রাস থেকে বাদ যায়নি। বাসে আগুন, ট্রেনে আগুন, গাড়িতে আগুন। কয়েকদিন আগে ট্রেনের ফিসপ্লেট খুলে ফেলে দিয়েছে ওই বিএনপি-জামায়াত। কারণ ট্রেনের বগি পড়ে যাবে, দুর্ঘটনায় মানুষ মরবে। মানুষ মারার ফাঁদ তারা তৈরি করেছে। এর থেকে ঘৃণার আর কী থাকতে পারে। ট্রেনে আগুন দিয়েছে, মা আর শিশু, মা তো শিশুকে ছাড়তে পারে না বুকে আগলে রেখেছে, সেই মা সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আগুনে পুড়ে কাঠ হয়ে গেছে। এই দৃশ্য সহ্য করা যায় না। বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস এবং জ্বালাও পোড়াও নাকি তাদের আনন্দ, এটাই নাকি তাদের আন্দোলন।

তিনি বলেন, যুদ্ধের কারণে আজ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। এই দ্রব্যমূল্যের অভিঘাত থেকে যাতে মানুষ রক্ষা পায় সেজন্য টিসিবির পারিবারিক কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। স্বল্পমূল্যে চাল, ডাল, তেল কেনার ব্যবস্থা করেছি। যাতে কোনো মানুষের কষ্ট না হয়। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সবার জন্য আমরা ব্যবস্থা করছি। পণ্যমূল্য কমানোর ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য রাখি কৃষক যেন তার ন্যায্যমূল্য পায়। কৃষকদের জন্য ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। প্রায় এক কোটি ৮ লাখ কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। দুই কোটির ওপর কৃষক উপকরণ কার্ড পায়। সেই কার্ড দিয়ে সার বীজ, কীটনাশক থেকে প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনতে পারে তারা। আমরা চাই আরও বেশি ফসল উৎপাদন হোক। আপনারা এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখবেন না। সবদিক থেকে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাই।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সারা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ দিতে সক্ষম হয়েছি। দুর্গত এলাকাগুলোতে সোলার প্যানেলের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। পাশাপাশি সবখানেই সোলার প্যানেল করে দিয়ে যাব, যাতে সবসময় বিদ্যুতের সুবিধা মানুষ পায়। আজকে প্রত্যেকটা ঘরেই আমরা বিদ্যুৎ দিতে সক্ষম হয়েছি। যে কথা দিয়েছি সেই কথা রেখেছি, এটাই হলো সবচেয়ে বড় কথা।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারে এসে জনগণের সেবা করে। আর জাতির পিতাকে হত্যা করে যারা ক্ষমতায় এসেছিল, তারা এসেছিল লুটপাট করতে। লুটপাট, সন্ত্রাস, মাদক, জঙ্গিবাদ এগুলোই ছিল তাদের কাজ। তারা মানুষের কল্যাণে কোনো কাজ করে নাই। তারা নিজেরা আখের গুছিয়েছে। আর আমার কৃষক-মজুর-শ্রমিক তারা মানবেতর জীবনযাপন করেছে। একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রত্যেকের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। শিক্ষায় দীক্ষায় সবদিক থেকে মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রংপুরে কখনো মঙ্গা হয়নি।

কোনো মানুষ গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, রংপুর বিভাগের অনেকগুলো উপজেলা গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের প্রায় ৩৪টি জেলা গৃহহীন ও ভূমিহীন মুক্ত হয়েছে, পর্যায়ক্রমে সব জেলা হবে। আমাদের সকল কাজই হচ্ছে জনগণের কল্যাণমুখী।

তিনি বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড-১৯ এর অতিমারী, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। ইসরাইয়েল প্যালেস্টাইনে যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই, ঘৃণা জানাই এই হত্যাকাণ্ডকে। এটা আমরা কখনো মেনে নিতে পারি না। ফিলিস্তিনিদের অধিকার অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। আমি যেখানেই থাকি বিদেশে যাই সব জায়গায় এটার প্রতিবাদ জানাই।

দেশের উন্নয়ন ও সম্ভাবনা, উন্নত ও সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে করণীয় এবং দেশের চলমান রজিনীতি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের সুযোগ পেয়ে দেশের উন্নয়নে সেই সময় খাদ্যে বাংলাদেশকে স্বয়ংসস্পূর্ণ করা হয়। বিনামূল্যে বই বিতরণ, বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, প্রতিবন্ধীভাতা দিতে শুরু করি। কমিউনিটি ক্লিনিক করে চিকিৎসাসেবা জনগণের দোরগোড়ায় দিতে শুরু করি। কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারিনি, একটা চক্রান্তের শিকার হই। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমরা ২৩৩ আসনে জয়লাভ করি আর বিএনপি পেয়েছিল মাত্র ৩০টি আসন। জাতীয় পার্টি তার থেকেও কম।

তিনি বলেন, আমরা সরকার গঠন করার পর থেকে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে কাজ শুরু করেছি। ১৯৯৬ সালে আমরা বর্গাচাষিদের বিনা জামানতে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত সেই সুযোগটা আমাদের বর্গাচাষিরা পাচ্ছে। ফসল উৎপাদনের জন্য গবেষণা শুরু করি। উচ্চ ফলনশীল ধান, গম, ভুট্টা, ডাল-মুগ তরিতরকারি-সবজি, মাছ-মাংস সবকিছুর যাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় সেই পদক্ষেপ আমরা নিতে শুরু করি। এভাবেই বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমরা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিয়েছিলাম।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আপনাদের মাঝে আসতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আরও বহু আগে এখানে আসার চেষ্টা করেছি। আপনারা জানেন করোনাভাইরাস শুরু হবার পর বেশির ভাগই আমি ভিডিও কনফারেন্সিং করেছি। সশরীরে খুব বেশি বাংলাদেশ ঘুরতে পারিনি। আগামী ৭ই জানুয়ারি নির্বাচন, সেই নির্বাচন সামনে রেখে আজকে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি।

তিনি বলেন, বিগত নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগকে আপনারা ভোট দিয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচন, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আপনারা এমন একজনকে ভোট দিয়েছেন যিনি (শিরীন শারমিন চৌধুরী) আমার কন্যার মতো। আমি তাকে এখানে (পীরগঞ্জে) এনেছি, এই কারণে তিনি অত্যন্ত মেধাবী এবং সেই সাথে পার্লামেন্টের স্পিকার। মহামান্য রাষ্ট্রপতির পরে স্পিকারের স্থান। আমরা পার্লামেন্টে বসি, আমি প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা। সেখানে পুরো পার্লামেন্ট প্রিজাইড করেন স্পিকার। এটা পীরগঞ্জবাসীর জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া থেকে আমি প্রধানমন্ত্রী আর পীরগঞ্জ থেকে স্পিকার এখান থেকে নির্বাচিত হয়।

শেখ হাসিনা বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে স্পিকারের গুরুত্ব অনেক বেশি। রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে স্পিকারই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। শিরীন শারমিন চৌধুরীকে ভোট দিয়ে আপনারা তাকে অনেক উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। এজন্য পীরগঞ্জবাসীকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই, ধন্যবাদ জানাই। নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আপনারা তাকে জয়যুক্ত করে আমাদের হাতকে শক্তিশালী করেছেন, যাতে গণতন্ত্র যেন আরও সুসংহত হয়।

বঙ্গবন্ধুকন্যা আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসতেন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতি হোক। এদেশের মানুষ হতদরিদ্র ছিল, একবেলা ঠিকমতো খাবার জুটতো না। পরণে ছিন্নকাপড়, রোগে চিকিৎসা নেই। মানুষের জীবনে কোনো আশা ভরসা নেই, এইভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো। এসব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তার নিজের জীবনকে উৎস্বর্গ করেছেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য। মানুষের এই দুঃখ, কষ্ট তিনি সহ্য করতেন না। তিনি ভাবতেন কিভাবে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করবে। সেই চিন্তা থেকেই তিনি তার জীবনে সংগ্রাম করে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে এই দেশকে স্বাধীন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে এই বাংলাদেশের মানুষ অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করে। এই ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। এই মাসের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। আমরা বিজয়ী জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে চলি।

সরকারপ্রধান বলেন, একটা স্বাধীন দেশ, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ। রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট, মসজিদ-মন্দির-প্যাগোডা সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত। যুদ্ধচলাকালীন কোনো ফসল ফলেনি। উত্তরবঙ্গে এই রংপুরের প্রতিটি এলাকায় দুর্ভিক্ষ লেগেই থাকতো, মঙ্গা লেগে থাকতো। এই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য জাতির পিতা বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে কাজ শুরু করেন এবং বাংলাদেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। মাত্র তিন বছর সাত মাস তিন দিন তিনি সময় পান, এরই মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্প উন্নত দেশ হয়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট যিনি এই দেশের মানুষের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন, একটা স্বাধীনতা এনে দিলেন, একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ দিলেন, তাকেই ঘাতকের দল নির্মমভাবে হত্যা করল। একই সাথে আমার মা, তিন ভাই, একমাত্র চাচা, ফুফুসহ পরিবারের অন্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই সময় আমি এবং আমার ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে ছিলাম। দেশে আসতে পারিনি। অবৈধভাবে যারা ক্ষমতা দখল করেছিল তারা আমাদের দেশে আসতে দেয়নি।

তিনি আরও বলেন, আমি কৃতজ্ঞতা জানাই আওয়ামী লীগের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি। ১৯৮১ সালে আমাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে। আমি তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশে ফিরে আসব। আমার ছেলেমেয়ে ছোট, তাদেরকে রেহানার কাছে রেখে আমি বাংলাদেশে চলে আসি। সমগ্র বাংলাদেশ আমি ঘুরেছি। আপনাদের পীরগঞ্জে বহুবার এসেছি, সারা বাংলাদেশ আমি ঘুরে দেখেছি। ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার দেখেছি, শীত গ্রীষ্মে বারো মাস তারা কষ্টে থাকে। এমন মানুষ ছিল যাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই অথবা কোনো মতে কুঁড়েঘরে বাস করে। আমার বাবার কথা চিন্তা করে আমি সিদ্ধান্ত নিই যেভাবেই হোক এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করব।

শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১ সালে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বিএনপি জয়ী হয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরা ২০০৮ সালে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর পুনরায় সেগুলো চালু করি। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়, ত্রিশ প্রকারের ওষুধ বিনা পয়সায় দেওয়া হয়। আমার মা-বোনদের আর কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না। রংপুর সবচেয়ে অবহেলিত জায়গা ছিল, এখানে প্রতিনিয়ত দুর্ভিক্ষ লেগে থাকত। তাই রংপুরকে আমি বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছি। আলাদা বিভাগ হওয়াতে আলাদা বাজেট হচ্ছে, সার্বিকভাবে রংপুরের উন্নয়নের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। রাস্তাঘাট, পুল-বিজ্র, নদীভাঙন থেকে রক্ষা করা... সার্বিকভাবে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি, যার সুফল রংপুরবাসী পাচ্ছেন।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে পীরগঞ্জের বদলে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, পীরগঞ্জের সাথে দিনাজপুরের সংযোগে আমরা ওয়াজেদ মিয়া সেতু নির্মাণ করে দিয়েছি। পীরগঞ্জ থেকে নবাবগঞ্জ, হিলি বন্দরে যাতে মানুষ সহজে যেতে পারে সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এমনকি গোবিন্দগঞ্জ থেকে গোড়াঘাট ব্রিজ করে দিয়েছি। এইভাবে সারা বাংলাদেশে প্রত্যেকটা এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা রাস্তাঘাট এমনভাবে উন্নত করে দিয়েছি মানুষ খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে যেতে পারবে। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পর উত্তরবঙ্গের সাথে রাজধানীর যোগাযোগ এবং তার সাথে রেলসেতু ও নতুন আরেকটি রেলসেতু তৈরি করে দিচ্ছি।

যুবসমাজের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, তোমাদের কর্মসংস্থানের জন্য কর্মসংস্থান ব্যাংক করে দিয়েছি। এই ব্যাংক থেকে বিনা জামানতে ঋণ নিতে পারবে, এই ব্যবস্থাটা আওয়ামী লীগ সরকার করে দিয়েছে। নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন, নৌকা মার্কা ক্ষমতায় আছে বলেই এটা পেয়েছেন। যারা তরুণ ভোটার ও নতুন ভোটার তাদের বলছি, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলব বলে ঘোষণা দিয়েছিলাম। আজকে বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ। মোবাইল ফোন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে কারো হাতে ছিল না। আজকে প্রত্যেকের হাতে হাতে মোবাইল ফোন আছে। এখন ওয়াইফাই কানেকশন সব জায়গায়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছি। ব্রডব্যান্ড কানেকশন দিয়ে দিয়েছি। শুধু তাই নয় লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং, শেখো এবং কাজ করে অর্থ উপার্জন করো, সেই ট্রেনিং দিয়েছি। ন্যাশনাল সার্ভিসের সুযোগ দিয়ে এই অঞ্চলের তরুণ সমাজের অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। যায় ফলে এখন ঘরে বসে আয় করার সুযোগ পাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষিত জাতি ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়। আমরা শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। আমি আপনাদেরকে যে প্রার্থী উপহার দিয়েছি, সেই শিরীন শারমিন জীবনে কোনোদিন ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয় নাই এবং বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। অত্যন্ত মেধাবী। আমরা চাই শুধু রংপুর বিভাগ নয় সারা দেশের মানুষই এভাবে শিক্ষা দীক্ষায় উন্নত হোক। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে। আমরা বিনা পয়সায় বই দিই। বই তো বাবা-মায়ের কিনে দেওয়ার কথা, কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সেই দায়িত্ব নিয়েছে। আমরা বৃত্তি দিই, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে বৃত্তি সেটা মায়ের নামে মোবাইল ফোনে চলে যায়। যারা উচ্চ শিক্ষা নিতে চায় তার জন্যেও বৃত্তির ব্যবস্থা করেছি। পীরগঞ্জে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এখানে শিরীন শারমিনের নেতৃত্বে মেরিন একাডেমি করে দিয়েছি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। একের পর এক উন্নয়ন করে যাচ্ছি।

শেখ হাসিনা বলেন, যারা কর্মজীবী  নারী তাদেরকে আমরা মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেছি। নারীদের কর্মসংস্থান তৈরিতে জয়িতা ফাউন্ডেশন আমরা করেছি। কেউ পিছিয়ে থাকবে না কেউ বেকার থাকবে না সেটাই আমাদের কথা। আমরা প্রত্যেক উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন করেছি। হাট-বাজারগুলো উন্নতমানের করে দিচ্ছি। এক সময়ের অবহেলিত পীরগঞ্জকে এখন সবাই চেনে। এই এলাকার সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। আমি শুধু বলব আপনারা ১৫ বছর আগের কথা চিন্তা করেন, আগে কী ছিল আর এখন পরিবর্তনটা কী হয়েছে। এই পরিবর্তনটাই আমাদের লক্ষ্য ছিল, সকলকে একটা সুন্দর জীবন দেওয়া।

তিনি আরও বলেন, যারা প্রবাসে যান তাদের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। জমিজমা বিক্রি করে বা বন্ধক রেখে বিদেশে যাওয়ার দরকার নেই, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশ যাবেন। তরুণ সমাজ যাতে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সেটাই আমরা চেষ্টা করছি। গোটা রংপুর বিভাগের জন্য আমরা দারিদ্র্য বিমোচন একাডেমিও তৈরি করে দিয়েছি। আমরা একেকটা উপজেলায় যা প্রয়োজন, তাই তৈরি করে দিচ্ছি। নদী-খাল-বিলসহ পুকুর ড্রেজিং করে মাছের চাষ বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

পীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক নুরুল আমিন রাজার সভাপতিত্বে জনসভায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বক্তব্য দেন। 

জনসভার আগে পীরগঞ্জের লালদীঘি ফতেহপুরে অবস্থিত বাসভবনে পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আত্মীয় স্বজনদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পাশাপাশি প্রয়াত স্বামী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়ার কবর জিয়ারত করেন প্রধানমন্ত্রী।

এর আগে শেখ হাসিনা তারাগঞ্জ ও মিঠাপুকুর উপজেলায় দুটি জনসভায় বক্তব্য দেন।

আরএআর