রংপুরের প্রথম একুশে পদকপ্রাপ্ত, দেশবরেণ্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, ‘চারণ সাংবাদিক’ মোনাজাতউদ্দিনের ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক জনকণ্ঠের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি। পত্রিকার জন্য সরেজমিন প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহের জন্য গাইবান্ধায় ছুটে গিয়েছিলেন। সেখানে ফুলছড়ি উপজেলার যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্ট থেকে ফেরিযোগে নদী পারাপারের সময় পা পিছলে নদীতে পড়ে গিয়ে তার মৃত্যু হয়।

ঘটনার এক দিন পর ৩০ ডিসেম্বর রংপুর শহরের মুন্সিপাড়া কবরস্থানে চিরদিনের জন্য শায়িত হয় মোনাজাতউদ্দিনের মরদেহ। সেদিন চির বিদায়ের সঙ্গে তিনি প্রশ্ন রেখে যান সবার মধ্যে সত্যি কি পা পিছলে পড়েছিলেন নাকি কোনো ষড়যন্ত্রে চলে যান না ফেরার দেশে। তার মৃত্যুর পর তৎকালীন বিএনপি সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। দীর্ঘ ২৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদন। খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনো কূল-কিনারা।

মোনাজাতউদ্দিন তার সমগ্র কর্মজীবনব্যাপী (তিন দশকেরও বেশি) উত্তরাঞ্চলসহ সারা দেশের পথে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে মানুষের জন্য সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। মফস্বল সাংবাদিকতার দিকপাল চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন একজন সফল গবেষকও ছিলেন। তার লেখনিতে উঠে এসেছিল গ্রাম-বাংলার অজানা অনেক কথা। সততা, ধৈর্য আর অসীম সাহসিকতাকে পুঁজি করে তিনি সাংবাদিকতায় নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যার কারণে তার লেখনিতে পাঠকরা ছিল সব সময় জাগরিত সমাজের একাংশ।

ছাত্র থাকাকালীন বগুড়ার সাপ্তাহিক বুলেটিন পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতা পেশায় আসেন। ১৯৬২ সালে স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে ঢাকার কাগজ দৈনিক আওয়াজ এবং ১৯৬৬ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। স্বাধীনতার পর তিনি নিজেই দৈনিক রংপুর নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। আর্থিক সমস্যার কারণে সেটি থমকে যায়। এরপর ১৯৭৬ সাল থেকে মোনাজাত উদ্দিন পূর্বদেশ ও দৈনিক সংবাদে প্রায় ২০ বছর কাজ করেন।

তার কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে ‘দৈনিক সংবাদ’-এর উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে (প্রায় দেড় যুগ)। তিনি ১৯৯৫ সালে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় যোগ দেন। মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত জনকণ্ঠই ছিল তার ঠিকানা। তিনি রংপুর কেরানিপাড়ার বাসা থেকে নানা অভাব-অনটনের মধ্য দিয়েও সাংবাদিকতা চালিয়ে যান। তিনি শুধু সাংবাদিকতায় ব্যস্ত ছিলেন না। ব্যস্ততা ছিল নাটক, গল্প, কবিতা আর ছড়া লেখায়ও। বাংলাদেশ বেতার রংপুর কেন্দ্রের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘করিম মন্ডলের বৈঠকখানা’র পাণ্ডুলিপি লেখার পাশাপাশি ভালো গীতিকার হিসেবেও তার ছিল বেশ সুনাম। তার রচিত একমাত্র নাটক ‌‘রাজা কাহিনি’।

এ ছাড়া মৃত্যুর আগে ও পরে মোনাজাতউদ্দিনের লেখা বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশ পায়। এর মধ্যে রয়েছে- সংবাদের নেপথ্য, পথ থেকে পথে, নিজস্ব রিপোর্ট, কাগজে মানুষেরা, নরনারী, শাহ আলম ও মজিবের কাহিনি, পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ, ছোট ছোট গল্প, কানসোনার মুখ, লক্ষ্মীটারী, চিলমারীর এক যুগ, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও মোনাজাতের শেষ লেখা ও শেষ দেখা ইত্যাদি।

উত্তরের অহংকার চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন সাংবাদিকতায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৪ সালে সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি পদক, দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘মানুষ ও সমাজ’ প্রতিবেদনের জন্য বাংলা ১৩৯৩ সালে ফিলিপস পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে অশোকা ফেলোশিপ লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে গণমানুষের সাংবাদিক হিসেবে তিনি মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন।

মফস্বল সাংবাদিকতায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকা দেশবরেণ্য এই সাংবাদিকের জন্ম হয়েছিল ভাওয়াইয়ার সুরে ভরা বাহের দেশখ্যাত রংপুরের উর্বর ভূমিতে। ১৯৪৫ সালের ১৮ জুন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা মৌলভী আলীম উদ্দীন আহমেদ আর মা মতিজান নেছা। মোনাজাতউদ্দিন কৈলাশ রঞ্জন স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে ভর্তি হন কারমাইকেল কলেজে। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় তার বাবাকে হারিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। পরে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস করেন। অনেক পথ থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সত্যের পথে। সেখান থেকেই সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে সমাজে সত্যের আলো তুলে ধরেছেন।

মোনাজাতউদ্দিন বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের একটি স্মরণীয় নাম। শুধু সাংবাদিক নন তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি ছিলেন তৃণমূল মানুষের সংবাদকর্মী, ছিলেন জনগণের সাংবাদিক। খবরের অন্তরালে যেসব খবর লুকিয়ে থাকে সেসব তথ্যানুসন্ধান এবং রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে তিনি নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে।

এদিকে চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের পরিবারের পক্ষ থেকে ২৯ ডিসেম্বর কবর জিয়ারত, বিশেষ দোয়া মাহফিল ও এতিম শিশুদের জন্য উন্নতমানের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনায় সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন তার স্ত্রী নাসিমা মোনাজাত ও দুই মেয়ে ডা. চৈতি ও ডা. সিঁথি। আজ রাত ৮টায় রংপুর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের স্মরণসভা ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া গঙ্গাচড়ায় সাংবাদিক আব্দুল মজিদ-মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদ দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

প্রসঙ্গত, রংপুরের সদ্যসাবেক বিভাগীয় কমিশনার (বর্তমানে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার) সাবিরুল ইসলামের প্রস্তাবে ও রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার উদ্যোগে রংপুরে ধাপ লালকুঠি এলাকায় (চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন যেখানে থাকতেন) তার পাশের রাস্তাটিকে (লালকুঠি মোড় ধাপ ৮তলা মসজিদ মোড়) ‘চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন সরণি’ এবং লালকুঠি মোড়টিকে ‘চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন মোড়’ হিসেবে নির্মাণ ও ঘোষণার কাজ বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন। রংপুরসহ সারা দেশের সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্টজনরা এই কাজের বাস্তবায়ন এবং উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছেন।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমজেইউ