সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি-চৌহালী) আসনে আওয়ামী লীগের দুই (নৌকা ও বিদ্রোহী) হেভিওয়েট প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র হিসেবে কাঁচি প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন চৌহালী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অবঃ) আব্দুল্লাহ আল মামুন। আসনটিতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছেন দুই হেভিওয়েট প্রার্থী। এদের মধ্যে একজন বর্তমান সংসদ সদস্য ও নৌকার প্রার্থী শিল্পপতি আব্দুল মমিন মন্ডল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। তবে এন্টি আওয়ামী লীগ ও তার নিজের এবং বাবার ব্যক্তি ও পারিবারিক জনপ্রিয়তাসহ ৫টি বিষয়কে কাজে লাগিয়ে কাঁচি প্রতীক নিয়ে এমপি হতে চান মেজর (অবঃ) আব্দুল্লাহ আল মামুন।

জানা গেছে, একইসঙ্গে অনেক বিএনপি নেতাও কাঁচি প্রতীকের নির্বাচন করছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়া এই মেজর (অবঃ) আব্দুল্লাহ আল মামুনের হয়ে।

যে ৫টি বিষয়কে কাজে লাগাতে চান তিনি
এন্টি আওয়ামী লীগ : মেজর (অবঃ) আব্দুল্লাহ আল মামুন তার প্রথম ভোট ব্যাংক হিসেবে ধরেছেন এন্টি আওয়ামী লীগকে। এর মধ্যে আছে বিএনপি সমর্থক ও নানান কারণে হয়তো আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এবং আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী এমন ভোটাররা তার মূল লক্ষ্য। তাদের ভোটকেই নির্বাচনে জেতার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ধরে নিয়েছেন এই প্রার্থী। তার মতে, এর মধ্যে অনেকেই আছেন যারা আওয়ামী লীগকে ভোট না দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে না যাওয়ার কথাই ভেবেছিলেন। কিন্তু তিনি প্রার্থী হওয়ায় তারা তাকে ভোট দেবেন। যেহেতু তিনি সাবেক বিএনপি নেতা তাই বিএনপির সমর্থকরাও তাকে ভোট দেবেন এবং আওয়ামী লীগের বিপক্ষে কাউকে তাদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে বেছে নেবেন।

ব্যক্তি ও পারিবারিক জনপ্রিয়তা
মেজর মামুন চৌহালী উপজেলার বিএনপির সাবেক নেতা এবং চৌহালী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। ২০১৪ সালে তিনি বিএনপির মনোনয়নে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে ২০১৯ সালে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। মেজর মামুনের বাবা আনছার আলী সিদ্দিকী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন সাবেক রাজনীতিবিদ, সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী এবং সাবেক সাংসদ ছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে চৌহালী আসন (সাবেক সিরাজগঞ্জ-৬ আসন) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

এ কারণে এলাকায় তার ও তার বাবার ব্যক্তি জনপ্রিয়তা রয়েছে। মেজর মামুনের মতে, তিনি এবং তার বাবা সাবেক জনপ্রতিনিধি। তারা দুজনেই জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এলাকার লোকজন ও সাধারণ ভোটার তাদের ভালোবাসেন, আপনজন ভাবেন। যেহেতু এর আগেও তারা ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং পারিবারিক এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে এই ভোট ব্যাংককে দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে কাজে লাগাতে চান তিনি। এছাড়াও তার ও তার বাবার নিজস্ব ভোট ব্যাংক রয়েছে বলেও জানান মেজর মামুন।

এপারের ভোট ওপারে না দেওয়া
যমুনা নদী ও যমুনার চর অধ্যুষিত চৌহালীর মানুষ নিজ এলাকায় প্রার্থী না থাকায় যমুনা নদীর ওপারে (বেলকুচি) ভোট দেন জানিয়ে মেজর মামুন বলেন, গত ১৭ বছর ধরে চৌহালী উপজেলায় কোনো এমপি নেই। এবার আমি চৌহালী থেকে চৌহালীবাসীর ভাগ্য উন্নয়নের আশা নিয়ে প্রার্থী হয়েছি। চৌহালীর মানুষ জানে যে, চৌহালীতে এমপি হলে চৌহালীর অনেক উন্নয়ন হবে। তারা সাধারণত এপারে (চৌহালীতে) প্রার্থী থাকলে ওপারে (বেলকুচির প্রার্থীকে) ভোট দিতে চান না। তাই এপারে যে বৃহৎ ভোট ব্যাংক রয়েছে সেই ভোটগুলো ভোটাররা আমাকে ভালোবেসে দেবেন। তিনি বলেন, এপারে (চৌহালীতে) ১ লাখ ১৬ হাজার ভোটার রয়েছে। চৌহালীর এই বিপুল মানুষ যদি দেখে যে নিজের দিকে বা নিজের ছেলেকে ভোট দেওয়ার সুযোগ হয়েছে তাহলে তারা নিজের ছেলে মনে করে আমাকেই ভোট দেবেন।

আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর কোন্দল ও ভোট ভাগ
মেজর মামুনের মতে, এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকেই দুইজন প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন। একজন নৌকা মনোনীত প্রার্থী ও আরেকজন স্বতন্ত্র থেকে। এর মধ্যে একজন বর্তমান এমপি ও আরেকজন সাবেক মন্ত্রী। যেহেতু দুইজনই আওয়ামী লীগের তাই এর মধ্যে দু-প্রার্থীরই কিছু নিজস্ব লোকজন থাকলেও আওয়ামী লীগের মূল ভোটারদের মধ্যেই দ্বিধা ও কোন্দল তৈরি হয়েছে। তারা কাকে ভোট দেবেন বুঝতে পারছেন না। এর ফলে এই ভোটগুলো যখন ভাগ হয়ে দুই দিকে হয়ে যাবে তখন কিন্তু ভোটের সংখ্যা কমে আসবে। এর মধ্যে কিছু ভোটার কিন্তু আবার ভোট বিরক্ত হয়ে আমাকে দেবে। ফলে বেলকুচির যে ২ লাখ ৮২ হাজার ভোট আছে এগুলো কিন্তু ভাগ হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে তাদের ব্যক্তিগত ভোটের সংখ্যা কমে আসবে।

স্থানীয় বিএনপির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন
বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও সাবেক এই বিএনপি নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় এই আসনের স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা তাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছেন ও কাজ করছেন। 

মেজর মামুন জানান, বিএনপির একটি অংশ এখন প্রকাশ্যেই তার সঙ্গে নির্বাচনে নেমে গেছে। আর আরেকটা অংশ আছে যে, তারা বলছেন আমরা প্রকাশ্যে নির্বাচনে নামব না তবে পরিবেশ অনুকূলে থাকলে ভোটটা দেব। তিনি বলেন, বিএনপির অনেক নেতাকর্মীই আমার জন্য কাজ করছেন। এর মধ্যে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যানসহ বিএনপির অনেক কমিটিরই নেতাকর্মীরা আছেন। যারা আমার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

নির্বাচনের সার্বিক বিষয় নিয়ে মেজর (অবঃ) আব্দুল্লাহ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিক থেকে এখন পর্যন্ত সবকিছু সুন্দরভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। তারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে আন্তরিক বলেই মনে হচ্ছে। এছাড়াও যেহেতু আওয়ামী লীগের দুজন হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছেন, তাই প্রত্যেকটা কেন্দ্রেই কিন্তু তাদের দুজনেরই এজেন্ট থাকবেন। তারাও কিন্তু কোনো পক্ষকে কারচুপি করার সুযোগ দেবেন না। এসব কারণে নির্বাচন ভালোভাবেই হবে বলে আমি মনে করছি।

এই আসনে এক শ্রমিকলীগ নেতার বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণে এক বোমা কারিগরের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই বিষয়টি কীভাবে নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে টাকার একটা বিষয় আছে। বাইরে থেকে ভাড়াটে লোক নিয়ে আসা বা এই ধরনের কিছু প্রচেষ্টা তো কিছুটা আছেই। আমরা ভোটারদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি, তারা হেভিওয়েট দুই প্রার্থীর কারণে সামাজিকভাবে একটা চাপে আছে। এই দুই প্রার্থীর লোক যখন স্থানীয়ভাবে ভোট চাইতে আসে তখন তাদের কিছুটা চোখ রাঙ্গানি, তোমরা যে অন্যেকে ভোট দিতে চাইছো বিষয়টা কেমন না? তবে নির্বাচনে এসব সামাজিক ব্যাপার থাকবেই। এসব ভীতি যারা কাটিয়ে উঠতে পারছে তারা অন্যের জন্য কাজ করছে, যারা পারছে না না তারা চুপচাপ আছে।

তিনি বলেন, আমি গণসংযোগ করতে গিয়ে দেখলাম যে, অনেকেই বলছে আমরা তো ভোট দিতে যেতাম না। কিন্তু যেহেতু আপনি ভোটে দাঁড়িয়েছেন তাহলে ভোট দিতে যাব। এই সাড়াটা আমি দারুণভাবে পাচ্ছি এবং ভালো লাগছে।

মেজর মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানুষ জনপ্রতিনিধি হিসেবে এমন একজনকে চায় যিনি, তাদের মাথার ওপরে ছাতা হয়ে থাকবেন। তাদের আস্থার মানুষকে তারা চায়। তারা চায়, তাদের ভালোবাসার মানুষ জনপ্রতিনিধি থাকুক। সেই জায়গা থেকে মানুষ আমাকে চায়। তারা ভালোবেসে আমাকে ভোট দেবেন, তাদের আস্থার মানুষকে ভোট দেবেন। তারা আমাকে ভালোবেসে, নিজের এলাকার উন্নয়নের কথা ভেবে তাদের আস্থার প্রতীক কাঁচি প্রতীকে ভোট দেবেন। এবং তাদের ভোটে জয়ী হবো ইনশাহল্লাহ।

এ সময় মেজর মামুন যোগ করেন, আমি এখানে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে এসেছি। আমরা যদি জিতি তাহলে হারবে কিন্তু নৌকা, আওয়ামী শক্তি। মূলত আমরা পরিবর্তনের মার্কা নিয়ে এসেছি এই কাঁচি মার্কা, প্রতিবাদের মার্কা হিসেবে নিয়ে আসছি আই কাঁচি মার্কা। নির্যাতিত মানুষের মার্কা হলো এই কাঁচি মার্কা। এটাও আমার আওয়ামী লীগের বিপরীতে একটা প্রতিবাদ। মানুষ যে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ভোট দিতে চায় এটা তার প্রমাণ।

চৌহালী উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আনিস শিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যমুনার চরে মানুষ। বার বার ভাঙনে আমরা নিঃশ্ব হবার উপক্রম। তাই আমাদের সার্বিক উন্নয়নে মেজর মামুনকে দরকার। এ কারণেই দিনরাত প্রত্যন্ত এলাকায় ছুটে চলেছি কাঁচি প্রতীকে ভোট চাইতে। মানুষের অভাবনীয় সাড়া পাচ্ছি জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষ মেজর মামুনকে ভোট দেওয়ার জন্য উদগ্রিব হয়ে আছে। মানুষ বুঝে গেছে একমাত্র মেজর মামুনই এই ভাঙনে দিশেহারা মানুষগুলোর ভাগ্য উন্নয়ন করতে পারেন। 

বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে তাহলে আপনারা কেন তার হয়ে নির্বাচন করছেন, দল তো আপনাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে ঢাকা পোস্টের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের এলাকার উন্নয়ন দরকার। শিক্ষা, স্বাস্থ, বাসস্থান, আইনশৃঙ্ক্ষলা স্বাভাবিক রাখাসহ মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা দরকার। যমুনার ভাঙনে দিশেহারা মানুষগুলোর সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা দরকার, মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের দরকার, তাই মেজর মামুনের নির্বাচন করছি। দল কি ব্যবস্থা নিবে সেটা ভাববার চেয়ে এলাকার মানুষের ভাগ্য ও সুন্দর ভবিষ্যত নিয়ে ভাবাটা বেশি জরুরি তাই সবকিছু ভুলে গিয়ে তার নির্বাচন করছি বলেও মন্তব্য করেন এই বিএনপি নেতা।

প্রসঙ্গত, এই আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৬৬১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৪ হাজার ৩৮১ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৯৪ হাজার ২৮০ জন। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে মোট চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে জয়ী হন নৌকার প্রার্থী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। এরপর ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে মোট ছয়জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ মনোনীত আব্দুল মমিন মন্ডল। নির্বাচনে মমিন মন্ডল (নৌকা) পেয়েছিলেন ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৬১ ভোট ও মো. আমিরুল ইসলাম খান (ধানের শীষ) পান ২৮ হাজার ৩১৭ ভোট।
 
সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি-চৌহালী) আসনটি থেকে এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ছয়জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হলেন- আব্দুল মমিন মন্ডল (নৌকা), আব্দুল লতিফ বিশ্বাস (ঈগল), মেজর (অবঃ) আব্দুল্লাহ আল মামুন (কাঁচি), ফজলুল হক (লাঙ্গল), আব্দুল হাকিম (নোঙ্গর) ও নাজমুল হক (গামছা)।

এমএএস