চুয়াডাঙ্গা শহরে কবরীর স্মৃতিবিজড়িত সেতাব মঞ্জিল

বাংলা সিনেমার মিষ্টি মেয়ে সারাহ বেগম কবরী আর নেই। কিন্তু চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের ‘কবরী রোড’ আর কবরীর স্মৃতিবিজড়িত সেই ‘সেতাব মঞ্জিল’ আজও আছে। বাড়িটি প্রায় আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটিতে কবরীসহ তার সহযোগী চলচ্চিত্র শিল্পীরা প্রায় এক মাস অবস্থান করেছিলেন। একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেই ১৯৬৯ সালে তারা এখানে এসেছিলেন। এই সিনেমার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান বেবী ইসলাম।

সিনেমার নাম ‘কখগঘঙ’। অভিনয় করেছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক, কবরী, আনোয়ার হোসেন, রাজু আহমেদ, হাবা হাসমত, রহিমা খালা, নাজনিন, তন্দ্রা ইসলাম, আব্দুল আলী লালু, শিশু শিল্পী মাস্টার অঞ্জন ও চুয়াডাঙ্গার কৃতী অভিনেতা প্রয়াত নান্টু ছাড়াও অনেকে।

জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বেলগাছি গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে বেবী ইসলাম একজন দক্ষ চিত্রগ্রাহক ছিলেন। তার আমন্ত্রণেই পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা চুয়াডাঙ্গায় এসে নির্মাণ করেছিলেন ব্যবসা সফল সিনেমাটি। সিনেমাটির চিত্রগ্রাহক ছিলেন বেবী ইসলাম নিজেই। কবরীরা যে বাড়িতে থাকতেন বাড়িটি ছিল বেবী ইসলামের নানাবাড়ি। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ও আলতাফ মাহমুদের সুরে ‘কখগঘঙ’ সিনেমায় গান গেয়েছিলেন মো. আলী সিদ্দিকী, ফেরদৌসী রহমান, মো. আবদুল জব্বার, সাবিনা ইয়াসমিন ও আলতাফ মাহমুদ। 

সিনেমাটি ১৯৭০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায়। কিন্তু তার আগেই চুয়াডাঙ্গা শহরের একটি রোডের নাম হয়ে যায় কবরী রোড। আজ পর্যন্তও ওই রোড কবরী রোড নামেই পরিচিত। কবরীর খুব ইচ্ছা ছিল একবারের জন্যও ফের চুয়াডাঙ্গায় যাবেন। ২০১৬ সালে একটি অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পাওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে কবরী বলেছিলেন, ‘আমাকে বললে আমি সেখানে যাব। নিজ খরচেই যাব। বেঁচে থাকতে রাস্তাটি দেখে যেতে চাই।’ 

চুয়াডাঙ্গা শহরের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ রাস্তার নাম ‘কবরী রোড’। রাস্তাটি পৌরভবন ও সরকারি কলেজকে সংযুক্ত করেছে। কবরীর নামে আপনা আপনিই ১৯৬৯ সালে সড়কটির নামকরণ হয় কবরী রোড। এই রাস্তায় রয়েছে সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি অফিস, অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দার ছেলুনের বাসভবন। 

চুয়াডাঙ্গার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এম সানোয়ার হোসেন বলেন, সারাহ বেগম কবরী ওই সময় খুব জনপ্রিয়। ওই সিনেমাটি করার সময় মানুষ সেতাব মঞ্জিল বাড়িটির সামনে ভিড় জমাত কবরীকে এক নজর দেখার জন্য। ছবির বেশিরভাগ শুটিং হয়েছিল ওই বাড়িতেই। এছাড়া জেলার জয়রামপুর রেলস্টেশন, শহরের সাতগাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে শুটিং হয়। আমিসহ বেশ কয়েকজন ওই সময় কবরীকে দেখার জন্য সেতাব মঞ্জিলে গিয়েছিলাম এবং আমাদেরকে কবরী নিজ হাতে মিষ্টি খাইয়েছিলেন।

 

আলমডাঙ্গা উপজেলার ভোগাইলবগাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মতিয়ার রহমান বলেন, ১৯৬৯ সালে আমি ক্লাস ফোরে পড়তাম। কবরীকে দেখার জন্য ওই সময় অনেকবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বড়দের চাপে আমার কবরী দর্শন হয়নি। 

প্রত্যক্ষদর্শী চুয়াডাঙ্গা কবরী রোডের মৃত কামরুল হক জোয়ার্দ্দারের ছেলে আহসান হাবিব জোয়ার্দ্দার বলেন, ওই সময় আমার বয়স ছিল আট বছর। আমি তখন ছোট ছিলাম। আমার বাড়ির পাশেই সেতাব মঞ্জিল। ওই বাড়িতে নায়িকা কবরীকে শুটিং করতে দেখেছি। রাজ্জাক, কবরী ও তন্দ্রা ইসলামকেও আমি শুটিংয়ের সময় দেখেছি। ওই বাড়ির সামনে একটি পুকুর ছিল, সেই পুকুরেও শুটিং হয়েছিল। সেই সময় এক নজর নায়িকা কবরীকে দেখতে মানুষ ভিড় জমাতো বাড়ির সামনে। 

চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের বাড়ির সামনের সড়কের নাম ‘কবরী রোড’। এ সড়কেরই ‘সেতাব মঞ্জিল’ নামের বাড়িতে শুটিংয়ের সুবাদে অবস্থান করতেন নায়িকা কবরী। সেই বাড়ি আর এই রাস্তা এখন এ শহরের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেই গরুর গাড়ি ( খানদানি ছই সংবলিত) নায়করাজ রাজ্জাক সিনেমার শুটিংয়ে হাঁকিয়েছিলেন, সেটির মালিক ছিলেন চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার জাফরপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি প্রয়াত হিরু মিয়া। যে পুকুরে তপস্বীর মত ছিপ ফেলে নায়করাজ মাছ ধরতে ব্যস্ত ছিলেন, যে পুকুরপাড়ে নায়করাজ নায়িকা কবরীর সঙ্গে মিষ্টি প্রেমের খুনসুঁটি করেছেন সেটি চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার সাতগাড়ি এলাকায় অবস্থিত।

এটি তালপুকুর হিসেবে পরিচিত হলেও বর্তমানে একটিও তালগাছের অস্তিত্ব নেই সেখানে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের প্রায় কেউই ‘কখগঘঙ’ সিনেমার শুটিং দেখেননি। তবে শুনেছেন যে এই পুকুরেই নায়করাজ আর কবরী শুটিং করেছেন। 

তারা জানান, পুকুরটির বর্তমান মালিক হোসেন আলী। এক সময় এই পুকুরের বাউরিতে (চারদিকের পাড়ে) অনেক তালগাছ ছিল। সে কারণে এটি তালপুকুর হিসেবে পরিচিত।

সরজমিনে দেখা যায়, কবরী রোডের পুরোনো নীরব-নিস্তব্ধ একতলা বাড়ি সেতাব মঞ্জিল। বাড়ির প্রকৃত মালিক মোরশেদ আহমেদ ওরফে তোকা মিয়া। তিনি সপরিবারে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় বসবাস করেন। এই বাড়িতে ব্যবসায়ী আখের আলী, স্ত্রী নিলুফা বেগমসহ দুই ছেলে থাকেন। অপর অংশ ছাত্রাবাস। করোনার সময় কোনো ছাত্র না থাকায় খালি পড়ে আছে। বাড়ির সামনে একটি বিশাল আমগাছ। পাশে দুটি সজনে গাছ আছে। বাড়ির মূল ফটক অনেক বড়। 

ভেতরে পুরোনো জরাজীর্ণ হলুদ একতলা বিল্ডিং। বিল্ডিয়ের কিছু কিছু স্থানে পলেস্তরা খসে পড়ে যাচ্ছে।  ভেতরে রয়েছে ইঁদারা (বড় পাকা কূপ)। এখানে অবস্থানকালে নায়িকা কবরী ইঁদারায় গোসল করতেন। ২০০৯ সালের পর থেকে আর ব্যবহৃত হয় না ইঁদারাটি। এমনটিই জানালেন সেতার মঞ্জিলের কেয়ারটেকার আখের আলী মোল্লা। বাড়ির সামনে অনেক পরিবর্তন হলেও ভেতরে রয়েছে নানা গাছ-গাছালি।
 
কথা হয় সেতাব মঞ্জিলের কেয়ার টেকার আখের আলী মোল্লার সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০০৬ সাল থেকে বাড়িটি আমি পরিবারসহ দেখাশোনা করে আসছি। সেই সময়কার অনেক কিছু না থাকলেও বাড়ির ভেতরে একটি ইঁদারা এখনও আছে। এই ইঁদারাতে নায়িকা কবরী গোসল করতেন। বাড়ির মালিক ঢাকায় থাকেন। আমি কবরী রোডের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ির দেখভালের দায়িত্বে আছি।

এই সিনেমার চিত্রগ্রাহক বেবী ইসলাম ২০১০ সালের ২৪ মে মারা গেছেন। তার ভাতিজা চুয়াডাঙ্গা বেলগাছির মতিয়ার রহমান পান্নু ও হাসিবুল রেজা শামীম বলেন, বেবী ইসলামের স্ত্রী আমার চাচি তন্দ্রা ইসলাম ওই সিনেমায় আনোয়ার হোসেনের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তন্দ্রা ইসলাম বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। ছেলে জয় ও মেয়ে বাংলা দুজনই আমেরিকায় থাকেন। বাংলা চলচ্চিত্র যতদিন থাকবে চুয়াডাঙ্গার মানুষ ততদিন কবরী ও বেবী ইসলামকে স্মরণ করবে।

এদিকে স্থানীয়রা জানান, আগামীকাল রোববার (১৮ এপ্রিল) নায়িকা কবরীর রুহের মাগফেরাত কামনায় সেতাব মঞ্জিলে স্থানীয়দের উদ্যোগে ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। 

আফজালুল হক/আরএআর