ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীতে বগুড়ায় আলুর খেতে লেটব্লাইট রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এতে আলুর গাছের পাতাগুলো কুকড়ে মরে যাচ্ছে। ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে ওষুধের আশ্রয় নিতে হচ্চে জেলার কৃষকদের। ফলে আলু চাষে খরচ বাড়ছে তেমনি উৎপাদন ঘাটতি নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন তারা।

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বগুড়ায় এবার ৫৫ হাজার ২৬০ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হয়েছে। যেখান থেকে ১৩ লাখ ২০ হাজার ৪৭৫ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। গত মৌসুমে জেলায় আলুর আবাদ হয়েছিল ৫৩ হাজার ২১৫ হেক্টর। আর উৎপাদন হয় ১২ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন। আলু উৎপাদনের ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত জেলা ধরা হয় বগুড়াকে।

কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আলুর জন্য শীত উত্তম আবহাওয়া। কিন্তু ঘন কুয়াশা ও তাপমাত্রা কম-বেশী হলে ছত্রাকজাতীয় রোগ লেটব্লাইটের আক্রমণ ঘটে। মূলত এটা ছাড়া আলুর আর তেমন কোনো রোগ দেখা যায় না। সাধারণত, কুয়াশার সময় আলু চাষে সপ্তাহে একবার ছত্রাকনাশক ছিটাতে হয়।

কৃষকরা জানান, লেটব্লাইট হলে প্রথমে আলু গাছের পাতা কুকড়ে যায়। ধীরে ধীরে গাঢ় সবুজ বর্ণ ধারণ করে। তারপর কোনো ওষুধই আর বাঁচাতে পারে না আলুর গাছ।

গেল মৌসুমে সারাদেশে আলুর দাম নিয়ে বড় ধরনের কারসাজি হয়। এখনও আলুর বাজার উচ্চমূল্য পর্যায়ে রয়েছে। বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পর আবাদ করতে গিয়ে চাষিদের অধিকমূল্যে বীজ ক্রয় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে লেটব্লাইট রোগে যদি আলুর চাষে বড় ধরনের ক্ষতি হয় তবে তা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় আঘাত হানতে পারে। পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ে আলুর দাম বৃদ্ধি পাবে।
 
আলু চাষে ইতোমধ্যে বীজ, সারসহ প্রতি বিঘায় প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান শিবগঞ্জ উপজেলার সুলতানপুর নয়াপাড়ার আজমল হোসেন। এখন এই রোগ দেখা দেওয়ায় বাড়তি খরচের ঝামেলায় পড়েছেন তিনি।

এই কৃষক বলেন, গত কয়েক দিনের শৈত প্রবাহে আলুর গাছে লেটব্লাইট রোগ দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে আলু গাছে পচন ধরেছে। গাছের বয়স ৪০ থেকে ৪৫ দিন, তবুও ওষুধ স্প্রে করেও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। গাছ মরে গেলে আমাদেরকে বড় অংকের লোকসান গুনতে হবে।

একই শঙ্কায় আছেন ওই গ্রামের আরেক আলু চাষি দুলাল মিয়া। তিনি প্রশ্ন বলেন, সেচ-শ্রমিকের খরচ বেড়েছে। ওষুধের দামও বাড়তি। এতো খরচের পর এবার আলু থেকে আয় আসবে কী? গতবার আমরা কৃষকরা ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি করেছিলাম আলু্। এবার সেই দামে আলু দেওয়ার মতো অবস্থা নেই।

লেটব্লাইট রোগ দেখা দিয়েছে কাহালু উপজেলার আলুর অনেক জমিতে। রোগটি থেকে রক্ষা পেতে ছত্রাকনাশক ওষুধ প্রয়োগ করছেন উপজেলা এরুল গ্রামের বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম। তিনি আড়াই বিঘা জমিতে স্টিক জাতের আলুর আবাদ করেছেন। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে খেতের আলুর গাছে একটু করে পাতা পচা ধরেছে।

জাহিদুল ইসলাম জানান, আলুর খেতে ছত্রাকনাশক ওষুধের পেছনে বেশি খরচ করতে হয়। জমি ভেদে তিন থেকে পাঁচ বার এই ওষুধ দিয়ে থাকে কৃষকরা। আমার জমিতে আলু তোলার আগ পর্যন্ত তিন হাজার টাকার মতো খরচ হয়। এবার এটি ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা হতে পারে।

শিবগঞ্জ উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাইফুর রহমান বলছেন, আলুর লেটব্লাইট রোগ ছত্রাকজাতীয় সংক্রমণ। এ রোগের জন্য আমরা প্রধানত ছত্রাকনাশক ম্যানকোজেন গ্রুপের ওষুধ প্রয়োগের পরামর্শ দিই্। সঠিক সময়ে সঠিক ওষুধ প্রয়োগ করলে ভয়ের কোনো কারণ নেই। তবে আলুর গাছ ৩০ দিন বয়সী হলে এসব ওষুধ বেশি কার্যকর হয়।

তিনি আরও বলেন, এবার ঠাণ্ডা বেশি। মাঠ পর্যায়ে দেখা গেছে যেসব জমিতে ৫ থেকে ৬ বার ছত্রাকনাশক দিতে হতো এবার সেখানে ১০ বার করেও দেওয়া লাগতে পারে। এতে কৃষকের খরচ একটু বেশি হবে বলে ধারণা করা যায়।  

জেলার সবগুলো উপজেলায় কমবেশি আলুর আবাদ হয়। তবে শিবগঞ্জ, কাহালু, শাজাহানপুর উপজেলায় এই আবাদের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। ঘন কুয়াশায় দেখা দেওয়া লেটব্লাইট রোগ বড় আকারে দেখা দেয়নি। বরং এসব উপজেলার বিভিন্ন এলাকার জমিতে বিক্ষিপ্ত আকারে আলুর গাছ আক্রান্ত হয়েছে। এটি আমাদের জেলার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় কোনো ঘাটতি ফেলবে না।
 
এমন তথ্য দেন বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শষ্য) নাজমুল হক মণ্ডল। তিনি বলেন, তীব্র শীতের জন্য এই রোগের প্রাদুর্ভাব। শীত কমে গেলেই রোগের প্রকোপ কমে আসবে। সব মিলিয়ে জেলায় সর্বোচ্চ ৫০০ হেক্টর জমির আলুর গাছ আক্রান্ত হয়েছে। এজন্য মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তারা নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।

আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/এমএএস