‘ভাবির মোড়’ নামটি শুনতে খটকা লাগলেও অবস্থানগত কারণে মোড়টির নাম এমনই। মূলত এই মোড়ে রয়েছে খাবারের চারটি হোটেল। যে হোটেলগুলোয় ভোজনরসিকদের খাবার পরিবেশন থেকে শুরু করে বিল (টাকা) নেওয়া পর্যন্ত সব কাজ করেন চারটি হোটেলের স্বত্বাধিকারী চার নারী। আর খাবার খেতে আসা লোকজন তাদের ‘ভাবি’ বলে সম্বোধন করতে করতে একসময় জায়গাটির নাম হয়ে যায় ‘ভাবির মোড়’।

দিনাজপুরের বোঁচাগঞ্জ উপজেলার ছাতইল ইউনিয়নের রাণীর ঘাট পরমেশ্বরপুর একটি সীমান্তবর্তী গ্রাম। এই গ্রামের মোড়েই রয়েছে চারটি খাবার হোটেলসহ ১২টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এলাকাটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে মানুষ মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারে করে খাবার খেতে আসে এই চার হোটেলে। কারণ, এখানে দেশীয় হাঁসের মাংস বেশ সস্তায় পাওয়া যায়। আর হোটেলগুলোর রান্না সুস্বাদু হওয়ায় তাদের জনপ্রিয়তাও বেশ তুঙ্গে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বোঁচাগঞ্জ ও বিরল উপজেলার শেষ অংশে টাঙ্গন নদের পূর্বদিকে ভাবির মোড়ের অবস্থান। পূর্ব-পশ্চিম রাস্তার দুই ধারে দুটি করে মোট চারটি ভাতের হোটেল। রাস্তার উত্তর পাশের দুই ভাইয়ের স্ত্রী এবং দক্ষিণ পাশে দুই বোন ভাতের হোটেলের ব্যবসা করেন। হোটেলগুলোর নাম ভাবি হোটেল-১, ভাবি হোটেল-২, ভাবি হোটেল-৩ এবং বেলি ভাবির হোটেল।

আরও দেখা যায়, বেলি ভাবির হোটেলের ভেতরে দেয়ালে বিভিন্ন ফুলের নকশাও আঁকা হয়েছে। প্রতিটি হোটেলের টেবিলে রাখা গামলাভর্তি হাঁসের মাংস। নিরিবিলি পরিবেশে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারে করে খেতে আসছেন বিভিন্ন এলাকার মানুষ। অনেকে পারসেল করে নিয়ে যাচ্ছেন। খাবার পরিবেশন থেকে শুরু করে বিল নেওয়া পর্যন্ত প্রায় সব কাজই করছেন নারীরা।

মোড়ের একটু পশ্চিমে এগোলে মিলবে টাঙ্গন নদ। সেই নদেই তৈরি করা হয়েছে রাবার ড্যাম। রাবার ড্যামের কারণে নদের এক পাশে পানি আর অন্য পাশ শুকনা অবস্থায় রয়েছে। ড্যামের নদীর পশ্চিমে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার ইন্দ্রল মোল্লাপাড়া এবং পূর্বে দিনাজপুরের বোঁচাগঞ্জ উপজেলার রাণীর ঘাট পরমেশ্বরপুর এলাকার ভাবির মোড়।

এখানে ব্যবসা পরিচালনা করছেন জালাল উদ্দিনের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার (৪০), জামাল উদ্দিনের স্ত্রী মাসতারা বেগম (৪৫), হোসেন আলীর স্ত্রী বেলী আক্তার (৪০) ও নাজমুল হকের স্ত্রী মেরিনা পারভীন (৩৭)। এ ছাড়া এখানে আরও ৮টি পান দোকান ও বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

তাসলিমার  তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। দোকান-সংলগ্ন একটি বাড়িও করেছেন। হোটেল ব্যবসা করেই তাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

জানতে চাইলে জালাল উদ্দিনের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার (৪০) ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে প্রতিটি খাবার হোটেলে প্রায় গড়ে ১৫ থেকে ২০টি দেশি হাঁস রান্না করা হয়। হাঁসের মাংসের সঙ্গে থাকে নদীর ছোট মাছের চটচটি ও শুকনা মরিচে করা মাছভর্তা, আলুভর্তা, বেগুনভর্তা ও শাকভাজি। ৫০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয় হাঁসের মাংসের প্রতি প্লেট। ভর্তা ১০ টাকা, শাক ১০ টাকা আর মাচ চটচটি ৩০ থেকে ৪০ টাকা এবং ভাত ১০ টাকা।

তিনি বলেন, প্রায় ৩০ বছর আগে শুষ্ক মৌসুমে নদী থেকে ট্রাকে করে এখানে বালু তোলা হতো। তখন এলাকাটিতে (রাণীর ঘাট) কোনো বসতি ছিল না। সেই সময় নদী থেকে দিনে ৫০ থেকে ১০০টি পর্যন্ত ট্রাকে বালু তোলা হতো। বালু তোলার শ্রমিকদের জন্য তখন কাজের ফাঁকে একটু চা-নাশতা করার জন্য ব্যবস্থা করা হয়। ঘাটের পাশেই পাঁচতারা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন জালালউদ্দিন। বালুতোলা শ্রমিকদের অনুরোধে তিনি দুপুরের খাবার হিসেবে ডাল-ভাত-ডিমের ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে ধীরে ধীরে রাণীর ঘাট নাম বদলে হয়েছে ভাবির মোড়।

ভাবির হোটেলে খাবার খেতে আসা আল আমিন গ্রুপের জোনাল সেলস ম্যানেজার মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমি এখানে দীর্ঘদিন থেকেই শখের বসেই খেতে আসি। এখানকার হাঁসের মাংসের স্বাদ অনেকটা ভালো লাগে। তাই সহকর্মীদের নিয়ে খেতে আসি।

তার সহকর্মী নূরে আলম বলেন, আমার বাসা বীরগঞ্জ উপজেলায়। অনেক আগে ভাবির মোড়ের হাঁসের মাংসের খাবারের প্রসংশার কথা শুনেছি। আজ বাস্তব খেয়ে দেখলাম। সত্যিই সুস্বাদু।

বিরল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে খেতে আসা আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা বিরল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে কয়েকজন খেতে এসেছি। এখানে আসার মূল কারণ হলো ভালো হাঁসের মাংস পাওয়া যায়। একই সঙ্গে রাবার ড্যাম দেখা।

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, একদিকে দেশি হাঁসের মাংসের মুখরোচক খাবার, অন্যদিকে টাঙ্গন নদীর ওপরে রাবার ড্যাম। মূলত এ দুটি কারণেই বেশ কয়েক বছর ধরে এখানে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ছে।

মোড়ে হোটেল ব্যবসায়ী মাসতারা বেগম বলেন, শুরুর দিকে একজনের ব্যবসার উন্নতি দেখে ধীরে ধীরে আরও তিনজন এখানে হাঁসের মাংস ও ভাত বিক্রি শুরু করেন। ঘাট বন্ধ হওয়ার পর ব্যবসায় কিছুদিন মন্দা গেছে। পরে রাস্তা পাকাকরণের কাজ শুরু হলে আবার বেচাবিক্রি শুরু হয়। আর এখন এমন পরিচিতি হইছে, দূর থাকি মানুষ এখানে খাবারের জন্য আসে।

নারীরা জানা, প্রতিটি দোকানের পুরুষরা দিনের বেশির ভাগ সময় উপজেলার বিভিন্ন বাজার থেকে হাঁসসহ বিভিন্ন বাজার সংগ্রহের কাজ করেন। আর নারীরা নিজেরাই খাবার পরিবেশন থেকে শুরু করে বিল নেওয়া পর্যন্ত সব কাজ করে থাকেন।

একটি হোটেলের স্বত্বাধিকারী বেলি বেগম বলেন, এখানে আমাদের মধ্যে বেশ সুসম্পর্ক। আমরা সবাই পরিবার নিয়ে ভালো আছি। বেশ ভালো লাগে যখন দূর থেকে মানুষ খাবার জন্য এসে ‘ভাবি ভবি’ বলেন। যে হোটেল তাদের পছন্দের, সেই হোটেলেই তারা তৃপ্তিসহকারে খাবার খায়। তিনি আরও বলেন, সকাল থেকে শুরু করে অনেক রাত অবধি দোকান খোলা থাকে। তবে শুক্রবার বেশি ভিড় থাকে।

জানতে চাইলে স্থানীয় ছাতইল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান হাবু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভাবির হোটেলে হাঁসের মাংসের রান্নার কারণে এলাকাটির নাম ভাবির মোড় হিসেবে মুখে মুখে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এখন রাণীর ঘাট পরমেশ্বরপুর নাম বদলে ভাবির মোড় হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। স্থানীয়রাই নয়, উপজেলার সীমানা থেকে শুরু করে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দিতে পারে ভাবির মোড়ে যাওয়ার রাস্তা।

এনএ