আগেকার দিনে আজকের মতো বাজার, বন্দর, হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁ ইত্যাদি সর্বত্র ছিল না, তখন মানুষ তাদের সফর অবস্থায় চলার পথে আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতজনের ঘর-বাড়ি না পেলে সরাইখানা, লঙ্গরখানা, মুসাফিরখানা ইত্যাদিতে অবস্থান করতেন। নওগাঁ জেলায় এমন এক মুসাফিরখানা আছে, যা আজও সেই স্মৃতি বহন করে চলছে।

নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার পশ্চিমে পোরশা উপজেলা সদরের মিনাবাজারে মুসাফিরখানাটি অবস্থিত। ১১৩ বছর ধরে এ অঞ্চলে সুনামের সঙ্গে সেবার উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হচ্ছে এই বিশ্রামাগারটি।

নওগাঁ পোরশা উপজেলায় ১৯০৮ সালে স্থানীয় ব্যক্তি খাদেম মোহাম্মদ শাহ তৈরি করেছিলেন একটি মাটির ঘর। ঘরের নাম দিয়েছিলেন মুসাফিরখানা। মানুষের রাত বা দিনে বিশ্রামের জন্যই এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। পাশাপাশি বিনামূল্যে খাবারেরও ব্যবস্থা করেছিলেন খাদেম মোহাম্মদ শাহ। এটি পরিচালনা ও এর সব ধরনের খরচ চালানোর জন্য তিনি মুসাফিরখানায় দান করে দিয়েছিলেন ৮০ বিঘা জমি। সেই ৮০ বিঘা জমিতেই বর্তমানের মুসাফিরখানাটি।

সরেজমিনে স্থানীয় বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা যায়, প্রায় ১৫০০ সালের পর কোনো এক সময়ে তৎকালীন বাদশা আলমগীরের আমলে ইরান থেকে হিজরত করতে বাংলাদেশের বরিশালে আসেন কয়েকজন শাহ বংশের লোক। তাদের মধ্যে ফাজেল শাহ, দ্বীন মোহাম্মদ শাহ, ভাদু শাহ, মুহিদ শাহ, জন মোহাম্মদ শাহ, খান মোহাম্মদ শাহ অন্যতম। পরবর্তীতে বরিশাল থেকে তারা আসেন বর্তমান পোরশা সদরে।

যদিও তখন এখানে কোনো বসতবাড়ি ছিল না। ছিল শুধু ঘন বনজঙ্গল। তখন হেঁটে চলত মানুষ মেঠোপথে। চলতে চলতে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামত। পথে বাঘ-শিয়ালের ভয়, চোর-ডাকাতের উপদ্রব। এসব কারণে মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে লোকালয় খুঁজত।

এলাকাটি ভালো লাগায় তারা এখানে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করতে শুরু করেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে স্ত্রী-সন্তানও ছিল। পরবর্তী সময়ে তাদের সন্তানের তাদের পরিবারের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বংশবিস্তার করান। এ প্রথাটি অর্থাৎ নিজেদের বংশের মধ্যে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রথাটি বর্তমানেও চালু রয়েছে পোরশায়। এখানে বসবাস করার পর থেকে এ এলাকার প্রচুর জমিজমা পেয়ে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এখানে জমিদারি করেন। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম বর্তমানেও এখানে রয়েছেন। তাদেরই বংশধর খাদেম মোহাম্মদ শাহ, যিনি এই মুসাফিরখানাটি নির্মাণ করেছিলেন।

পোরশা সদরের মিনা বাজারের বড় মসজিদের কাছেই মুসাফিরখানা। রাস্তার সঙ্গে লাগানো পূর্ব-পশ্চিম লম্বা দোতলা ভবন। ভেতরে প্রবেশের আগেই রয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। এতে একসঙ্গে ৬০ জন থাকা যায়। সবার থাকার সঙ্গে খাবারও ফ্রি। মুসাফিরখানা পরিচালনার জন্য কর্মচারী রয়েছেন ১ জন ও ম্যানেজার রয়েছেন ১ জন। এটি পরিচালনার জন্য একটি কমিটি রয়েছে। পরিচালনা কমিটির সভাপতি হাজী জামিলুর রহমান। তিনিই মুসাফিরখানার সব বিষয়ে খোঁজখবর নেন এবং দেখাশোনা করেন।

ম্যানেজার সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, তিনি এখানে প্রায় ৩০ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। প্রতিদিন কমবেশি এখানে মানুষ থাকে। আর তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। আর প্রায় ৬০ জন মানুষকে একসঙ্গে এখানে রাখার মতো ব্যবস্থা রয়েছে বলেও তিনি জানান।

পরিচালনা কমিটির সভাপতি হাজি জামিলুর রহমান ঢাকা পোস্টকে জানান, ১৯০৮ সালে এটি প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ৮০ বছর মাটির ঘরেই এর কার্যক্রম পরিচালনা হয়েছে। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে মুসাফিরখানার জমিজমার আয় দিয়েই বর্তমান ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রতিদিন কমবেশি এখানে মানুষ থাকে। তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। অন্যান্য দিনের তুলনায় রমজান মাসে এখানে মানুষের ব্যাপক ভিড় হয় বলে তিনি জানান।

স্থানীয় বাসিন্দা ওমর আলী বলেন, মানুষের যাতায়াতের সুবিধার জন্য প্রয়াত খাদেম মোহাম্মদ শাহ মুসাফিরখানা তৈরি করেছিলেন। এখানে ধনী-গরিব সবার জন্য থাকা-খাওয়া বিনা মূল্যে।

মুসাফিরখানার খাদেম মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে জানান, দেশ-বিদেশ থেকে অনেকেই এখানে আসেন। এমনকি রমজান মাসে ধর্মপ্রাণ মানুষসহ বড় আলেমরা এখানে এসে জাকাত সংগ্রহ করেন। বর্তমানে সপ্তাহে এক দিন বুধবারে মুসাফিররা খাওয়াদাওয়া করেন এখানে।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুল হামিদ রেজা ঢাকা পোস্টকে জানান, ১১৩ বছর আগে এ এলাকায় সেবার উদ্দেশ্যে মুসাফিরখানাটি তৈরি হয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠানটি এখনো বেশ সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। মানবতার সেবায় অসাধারণ উদাহরণ তৈরি করেছেন খাদেম মোহাম্মদ শাহ।

এনএ