‘দোকানদারদের কাছে গিয়ে বলছি, তারা ওষুধ দিচ্ছে, আমরা ব্যবহার করছি। কৃষি বিভাগ বা কৃষি অফিসাররা কোনো গুরুত্ব দেয় না। তারা আমাদের কোনো পরামর্শ দেয় না। মাঠে আসা তো দূরের কথা, গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সাথে কথাও বলে না।’

কথাগুলো বলছিলেন জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার কৃষক আব্দুর নূর। তিনি সাড়ে ৪ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন। তার আলুর ক্ষেত লেটব্লাইট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। 

এই কৃষক  বলেন, আলুতে পচা রোগ ধরার পর তো আমরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে গেছি। এক বিঘা জমিতে যদি ৪০ হাজার টাকা খরচের পর আবার এমনভাবে পচা রোগ ধরে গাছ মরতে শুরু করে, তাহলে আলু হবে কীভাবে? আবার টাকা উঠবে কীভাবে?

আগাম আলুতে ফলন ও দাম ভালো পাওয়ায় লাভের মুখ দেখলেও লেটব্লাইট রোগের কারণে ভরা মৌসুম এবং শেষভাগের আলু নিয়ে আব্দুর নূরের মতো জয়পুরহাটের অনেক চাষি দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর গাছের কাণ্ড পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে আলুর ফলন কমে যাওয়ার শঙ্কা করছেন কৃষকরা।

জানা গেছে, আলু উৎপাদনের অন্যতম শীর্ষ জেলা জয়পুরহাটে ২০২১-২২ মৌসুমে ৪০ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছিল। তারপরের ২০২২-২৩ মৌসুমে এক হাজার ৬৫৫ হেক্টর কমে ৩৮ হাজার ৬২৫ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। ২০২৩-২৪ এর এই মৌসুমে গতবারের তুলনায় ৩২৫ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ বেশি হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার জেলায় ৩৮ হাজার ৮১৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। আর আলু চাষ হয়েছে ৩৮ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে। সে তুলনায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩৫ হেক্টর বেশি জমিতে আলুর চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৬ হাজার ৮৫০ হেক্টর, পাঁচবিবি উপজেলায় ৬ হাজার ৯৫০ হেক্টর, আক্কেলপুরে ৫ হাজার ৯২০ হেক্টর, ক্ষেতলালে ৮ হাজার ৫৮০ হেক্টর ও কালাই উপজেলায় ১০ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। মোট জমির মধ্যে ৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আগাম আলু চাষ হয়েছে।

১৮ জাতের আলু চাষ

জয়পুরহাটের কৃষকরা স্থানীয় পাকরি, পাটনাই ও হাগরাই মিলে ৩ জাত ও উফশী ১৫ জাত মিলে ১৮ জাতের আলু চাষ করেছেন। উফশী জাতের মধ্যে রয়েছে বারি আলু-১৩ (গ্র্যানোলা), বারি আলু-২৫ (এসটেরিক্স),বারি আলু-৮ (কার্ডিনাল), রোমানা, বারি আলু-৭ (ডায়মন্ড), সাদিকা, বারি আলু-২৮ (লেডি রোসেটা), বারি আলু-২৬ (ফেলসিনা),বারি আলু-২৯ (কারেজ),বারি আলু-৮৬, বিএডিসি আলু-৭ (কুইনঅ্যানি),বারি আলু-৫৪ (মিউজিকা), অ্যালুইট, সানসাইন ও ভ্যানেলসিয়া জাত। এই ১৫ জাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৫ হাজার ৫৭৫ হেক্টর জমিতে এসটেরিক্স জাতের আলু চাষ হয়েছে।

আগের বছরগুলোতে আলু গাছের কাণ্ড পচা বা লেটব্লাইট রোগ হলে কীটনাশক স্প্রে করলে দমন করা যেত। কিন্তু এবার কোনো কাজই হচ্ছে না বলে অভিযোগ কৃষকদের। তারা জানান, আগে থেকে আবহওয়ার কোনো খবরও কৃষি বিভাগ থেকে জানানো হয় না। কিছু দিন আগে দিনের আবহাওয়া কখনো ঠান্ডা আবার কখনো গরম ছিল। এরপর হঠাৎ করে ঘন কুয়াশা ও কনকনে শীত নামার পর আলু গাছের কাণ্ড পচে যাচ্ছে। এর ফলে আলুর আশানুরূপ ফলন না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ক্ষেতলাল উপজেলার কৃষক আপন হোসেন বলেন, জয়পুরহাট জেলায় অন্য ফসলের চেয়ে আলু চাষ মোটামুটি বেশি হয়। বর্তমান আবহওয়ার কারণে আলু গাছের কাণ্ড পচে যাচ্ছে। আর কাণ্ড পচে গেলে গাছ দুর্বল হচ্ছে। দুর্বল গাছ থেকে আলু সেভাবে হয় না। মাঠপর্যায়ে যে কৃষি অফিসাররা আছে তারাও আমাদের খোঁজ-খবর নেন না। তারা মাঠে এসে ওষুধের নাম ও ব্যবহার সম্পর্কে জানালে আমরা সেগুলো ব্যবহার করতাম। আমরা কীটনাশকের দোকানদারদের কাছে গিয়ে রোগের নাম বলে ওষুধ নিয়ে এসে দিচ্ছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। কীটনাশকের দোকানদারেরা তো কৃষিবিদ না, তারা তো সঠিক কোনো পরামর্শ দিতে পারছে না।

একই উপজেলার কৃষ্ণনগর এলাকার শফিকুল ইসলাম নামে এক কৃষক সাড়ে চার বিঘায় আলু চাষ করেছেন। এর মধ্যেএক বিঘায় ডায়মন্ড ও সাড়ে তিন বিঘা জমিতে এসটেরিক্স জাতের আলু চাষ করেছেন। এই কৃষক বলেন, আলুর গাছ পচা রোগ এমন থাকলে আমাদের ফসলের অনেক ক্ষতি হবে। এতে আমাদেরও ক্ষতি হবে। এজন্য জমিতে বারবার ওষুধ দিচ্ছি। যাতে আলুর ক্ষেত ভালো থাকে।

হাদিস খান নামে আরেক কৃষক বলেন, আমরা অনেকেই মানুষের জমি কট (বন্ধক) নিয়ে চাষ করি। আমি আড়াই বিঘাতে আলু চাষ করেছি। অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করে ওষুধ কিনে এনে জমিতে প্রয়োগ করছি। কিন্তু কোনোভাবেই এই রোগ থামানো যাচ্ছে না। এতে আমাদের অর্থ বেশি ব্যয় হচ্ছে। আবার জমিতে কোনো উপকারও দেখতে পাচ্ছি না। প্রতি সপ্তাহে দুবার-তিনবার কীটনাশক স্প্রে করছি, তাতেও পচন আটকানো যাচ্ছে না। এক জমিতে পচা রোগ ধরলে সেখান থেকে পাশের জমিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এখন আমরা কৃষকরা খুব বিপদের মধ্যে পড়ে গেছি। আগের বছরগুলোতে একবার-দুবার ওষুধ দিলে গাছ তাজা ও ভালো থাকতো। এক সপ্তাহ বা পনের দিন পর স্প্রে করলেও কোনো সমস্যা হতো না। এখন ওষুধ কাজই করছে না। আবহাওয়ার দোষ, না ওষুধের দোষ তা আল্লাহ্পাক ভালো জানে।

ক্ষেতলাল উপজেলার পাঠানপাড়া বাজারের কীটনাশক ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেন বলেন, কৃষকেরও কিছু ভুল আছে। আলু গাছের বয়স ২৫ বা ৩০ দিন তখন থেকে ওষুধ দেওয়া শুরু করতে হবে। কিন্তু আলুর গাছে যখন পচা ধরে, তখন ওষুধ দিতে দৌড়ায়। আবার তার পাশের জমিওয়ালারা বলে এখনো ধরেনি। ধরলে দিমু। তখন ওষুধ দিলে কাজ কম করে। আবার আবহাওয়াও ভালো নয়। আবার ওষুধে তো প্রচুর দুই নম্বরি আছে, এটাও সত্য। এখন দাম কমের কারণে ওইসব ওষুধ কিনছে কি-না, তা কীভাবে বলবো?

আরেক কীটনাশক ব্যবসায়ী আব্দুল আলিম বলেন, কৃষি বিভাগের লোকজন নিয়মিত আসে। এসে তারা প্রোডাক্ট চেক করে থাকে। তারপরও আলুর যত প্রকার ওষুধ আছে তার সবই ব্যবহার হচ্ছে। কোনো না কোনো দোকান থেকে কিনে ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু দেখতেছি ৫০ শতাংশ কাজ হচ্ছে। এটি আবহাওয়ার কারণে। আলুর ছত্রাকের ওপর যে ওষুধ আছে, এগুলোই ব্যবহার করতে বলছি। কিন্তু কৃষকরা পাউডারের সাথে তরল ব্যবহার করছে। তাছাড়া নিজেরাই নিজেরাই বিভিন্ন গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার করছে। এখানে আমরা কী মতামত দেব?

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোছা. রাহেলা পারভীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, হঠাৎ করে তাপমাত্রা অত্যন্ত কমে গেছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির আকারে কুয়াশা পড়ছে। এটা আলু চাষের জন্য প্রতিকূল আবহাওয়া। এতে করে আলুর লেটব্লাইট রোগ দেখা দিয়েছে। এই আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষার্থে আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি। একটু বেলা করে জমিতে ওষুধ স্প্রে করতে বলা হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা কৃষকদের কাছে লিফলেট বিলি করছি। সেখানে ওষুধ ও তার ব্যবহার সম্পর্কে লেখা আছে। কিন্তু কৃষকরা সরাসরি দোকানে ওষুধ কিনতে চলে যায়। তারা আমাদের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে ওষুধ দিতে পারেন। তাছাড়া আমরাও তাদের পাশে আছি। তাছাড়া কোনো ওষুধ নিয়ে সন্দেহ হলে আমরা ওষুধের স্যাম্পল নিয়ে টেস্টের জন্য ল্যাবে পাঠিয়ে দিই। রেজাল্ট আসলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

আরএআর