পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হওয়ার পর শরীয়তপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি পণ্য উৎপাদনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। কৃষি নির্ভর অঞ্চল হওয়ায় রবিশস্য মৌসুমে শরীয়তপুরে প্রচুর পরিমাণে মধু উৎপাদন হয়। মধু উৎপাদন করে চাষিরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে রাখছেন ভূমিকা। বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন ফুলের মধু সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলার মৌ চাষিরা। মৌ চাষিরা বছর জুড়ে মৌমাছি লালন-পালনসহ অন্যান্য খরচ মিটিয়ে লাভের মুখ দেখবেন বলে প্রত্যাশা কৃষি বিভাগের। 

সম্প্রতি শরীয়তপুর সদরসহ জাজিরা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মৌ চাষিদের মধু উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে। মৌসুমের বর্তমান সময়ে সরিষা ফুলের মধু উৎপাদন হলেও একমাস পর থেকে কালোজিরা, ধনিয়াসহ অন্যান্য ফুলের মধু সংগ্রহ করতে পারবেন চাষিরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, শরীয়তপুর জেলায় সরিষা, কালোজিরা, ধনিয়াসহ বিভিন্ন ফুলের মধু পাওয়া যায়। বর্তমানে সরিষার গাছে ফুল আসায় এসব ফুল থেকে বাণিজ্যিকভাবে মধু আহরোণ করছেন জেলার মৌ চাষিরা। গত বছর শরীয়তপুরে সরিষা ফুলের মধু ৬ হাজার ৪৮০ কেজি, ধনিয়া ফুলের মধু ১২ হাজার ৭৫০ কেজি ও কালোজিরা ফুলের মধু ১১ হাজার ৩৭০ কেজিসহ মোট ৩০ হাজার ৬০০ কেজি মধু উৎপাদন হয়েছে। এসব মধু উৎপাদন করতে ১০ হাজার ২০০টি মৌ বাক্স স্থাপন করা হয়েছিল। এবছর এখন পর্যন্ত মধু আহরোণের জন্য শরীয়তপুর জেলার বিভিন্নস্থানে ১ হাজার ৫০টি মৌ বক্স স্থাপন করা হয়েছে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হওয়ায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকারি ক্রেতারা জাজিরাসহ শরীয়তপুরের বিভিন্ন খামার থেকে মধু ক্রয় করেন বলে চাষিরা নিশ্চিন্তে মধু বিক্রি করতে পারছেন। কৃষি বিভাগ গত বছরের চেয়ে এবছর বেশি মধু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে।

মৌ চাষি জাহিদ হাসান শরীয়তপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মধু উৎপাদন করেন। তিনি কৃষি বিভাগ থেকে ১৭৫টি মৌ বাক্স পেয়েছেন মধু উৎপাদনের জন্য। এসব মৌ বক্সের প্রতিটি বক্সে ১টি রাণী মৌমাছিসহ লক্ষাধিক কর্মী মৌমাছি থাকে। কর্মী মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু আহরোণ করে মৌচাকে নিয়ে সংরক্ষণ করে। মৌচাক থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মধু উৎপাদন করে বাজারজাত করেন তিনি।

মৌ চাষি জাহিদ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সারা বছর মৌমাছিদের লালন-পালন, কর্মচারীদের বেতনসহ আমার খরচ হয় ৩ লাখ টাকা। এবছর আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় মধু উৎপাদন তুলনামূলক কম হলেও আমার টার্গেট বর্তমান মৌসুমে ৮ লাখ টাকা মূল্যের মধু উৎপাদন করা। টার্গেটের বড় একটা অংশ আমি সরিষা ফুলের মধু থেকে উত্তোলন করতে পারব বলে আশাবাদী। মধু উৎপাদনের জন্য কৃষি বিভাগের দেওয়া উপকরণসমূহ আধুনিক হওয়ায় সম্পূর্ণ খাঁটি মধু উৎপাদন করা সম্ভব হয়। বাজারে মধুর চাহিদা ব্যাপক বলেই কোনো চাষিরই লোকসানে পড়তে হয় না। এক সময় বেকার ছিলাম। এখন আমার খামারে ৪ জন কর্মচারী কাজ করে।

জাহিদ হাসানের মৌ খামারে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন রিয়াদ হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথম দিকে মৌমাছিকে ভয় লাগত। এখন মৌমাছির সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। মৌ খামার থেকে যে বেতন পাই, তা দিয়ে আমার সংসার চলে যায়। আবহাওয়া ভালো থাকলে মালিক মৌসুম শেষে বেশি করে সম্মানি দেন। এবছর আবহাওয়া ভালো না হলেও আলহামদুল্লাহ মধু উৎপাদন ভালোই হবে বলে মনে হচ্ছে।

জাহিদ হাসানের মত মৌ বাক্স দিয়ে মধু উৎপাদন করেন আনোয়ার হোসেন। এ বছর তিনি জাজিরা উপজেলার বিলাশপুর ও টিঅ্যান্ডটি মোড়ে মৌ বাক্স বসিয়ে মধু উৎপাদন করেছেন। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, মৌমাছিসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে মৌসুমে আমার ব্যয় হবে প্রায় ১১ লাখ টাকা। আমার ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা মূল্যের মধু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। বর্তমানে শুধু সরিষা ফুলের মধু উৎপাদন করছি। কিছুদিন পর ধনিয়া, কালোজিরাসহ অন্যান্য ফুল ফুটলে ওই সব ফুলের মধুও উৎপাদন করতে পারব। পদ্মা সেতু হওয়ায় এখন ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা এসে মধু কিনে নিয়ে যায় বলে লাভ একটু বেশি হয়। আশা করছি গত বছরের তুলনায় এবছর বেশি লাভবান হতে পারব।

শরীয়তপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. রবীআহ নূর আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, রবিশস্য মৌসুমে জেলার মৌ চাষিরা উৎসাহ নিয়ে মধু উৎপাদন করেন। কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় নিজেদের ভাগ্য বদলের পাশাপাশি মানবদেহের জন্য উপকারী মধু উৎপাদন করে তারা দেশের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখতে ভূমিকা রাখেন। গত বছরের তুলনায় এবছর আমাদের মধু উৎপাদন বেশি হবে বলে আশা করছি।

সাইফ রুদাদ/আরকে