যুগে যুগে সব ক্রান্তিলগ্নে তরুণরাই হাল ধরেছেন। তারুণ্যের শক্তি আর কর্মদক্ষতায় সব সময় জয়ী হয়েছে। বর্তমান বিশ্ব যখন মহামারি করোনায় পর্যুদস্ত, তখন জেগে উঠেছে তারুণ্য শক্তি। লকডাউনের সময় অসহায় মানুষের পাশে যখন কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন আলোর ঝলকানি হয়ে দাঁড়িয়েছে তরুণসমাজ।

তরুণদের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে করোনায় আক্রান্তদের সেবা, মৃতদের দাফন, কর্মহীনদের বাড়িতে খাদ্যসামগ্রী, বিনামূল্যে আহার বিতরণ, এতিমখানায় শিশুদের নিয়ে ইফতার ও নৈশভোজসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ।

এমন মানসিকতা আর উদ্যোগ নিয়েই করোনার শুরু থেকেই লক্ষ্মীপুরের তরুণসমাজের গড়ে তোলা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো মাঠে থেকে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের ফেসবুকে অসহায়দের সহযোগিতার ছবিই বেশি স্থান পেয়েছে। এতে সচেতন মহল তরুণদের জয়গান করছে। তাদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি যেন সমাজের প্রতিটি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে, এমনটিই প্রত্যাশা সবার।

এদিকে অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো তরুণরা সমাজের বিত্তবান-সচ্ছল সুহৃদদের কাছে একটি মানবিক আবেদন উপস্থাপন করে আসছেন। তা হলো, 'উদ্ভূত সংকটে মানুষ অনেক কষ্টে আছে। দয়া করে যার যার সাধ্যমতো প্রকৃত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। কতটুকু পারবেন, সেটি মুখ্য বিষয় নয়, আপনি যতটুকু পেরেছেন, সেটাই শ্রেয়। সাধ্যমতো চেষ্টা করুণ, যতটুকু সম্ভব। নিশ্চয়ই আল্লাহ এর উত্তম প্রতিদান দেবেন'।

জানা গেছে, মেঘ ফাউন্ডেশন, অগ্রযাত্রা ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবী ও আদর্শ সামাদিয়ানদের কয়েকটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে পৃথক পৃথকভাবে মানুষকে সহযোগিতা করে আসছেন। এ ছাড়া ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীকেও অসহায়দের মাঝে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে দেখা গেছে। তরুণদের ভিন্নধর্মী উদ্যোগগুলো অসহায়দের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে নিয়মিত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা শহরের উত্তর তেমুহনী ও সদর উপজেলার পালের হাট, জকসিন ও খিলবাইছাসহ বিভিন্ন এলাকায় একদল তরুণ বিনামূল্যে অসহায় কর্মজীবী মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করেছেন। মেঘ ফাউন্ডেশন ও অগ্রযাত্রা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে তারা গত চার দিনে ওই স্থানগুলোতে গিয়ে দুই শতাধিক মানুষের মাঝে ইফতারিসহ রাতের খাবার বিতরণ করেছেন। ফাহাদ বিন বেলায়েত, রিয়াদ হোসেন, রাজীব হোসেন রাজু ও সৈয়দ নুর হোসেন ফাহাদসহ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীকে ভূমিকা রাখতে দেখা যায়।

রমজান মাস উপলক্ষে সদর উপজেলার অর্ধশতাধিক পরিবারের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছে স্টুডেন্টস ওয়েলকেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের এসব কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হবে বলে তারা জানিয়েছে।

এদিকে লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের এসএসসি ২০১৮ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিয়েছে। গত চার দিনে তারা শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে গিয়ে রিকশাচালক ও ভিক্ষুকসহ অসহায়দের মাঝে ইফতারি বিতরণ করেছে। শহরের কালু হাজী সড়কের একটি প্রতিবন্ধী হাফেজিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে দ্বিতীয় রমজানের ইফতার ও রাতের খাবার খেয়েছেন তারা। প্রতিদিনই তারা ভিন্নধর্মী আয়োজন নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে।

এমনকি সড়কে যানজট নিরসনে কাজ করা ট্রাফিক পুলিশকে ইফতারি দিতে ভুল করেননি এ শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে ইফতে সামুল হক অবিনাশ, আকবর হোসেন, ফয়সাল বিন কামাল নাহি, ওসামা বিন খায়ের ফাহাদ, মেহেদি অন্তর, আরাফাত অপুসহ অনেকেই কাজ করছেন। করোনার শুরু থেকেই নিজেদের পকেট খরচ থেকে অসহায়দের পাশে আছে এ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।

লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফাহিমুল ইসলাম রাফি পাটওয়ারী নিজ পরিবারের পক্ষ থেকে রাতের অন্ধকারে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছেন। তার এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ফাহাদ বিন কামাল মাহি। শনিবার (১৭ এপ্রিল) বিকেলে ছাত্রলীগ নেতা মিনহাজ আলম সাকিব ও খালেদ মাহমুদ অন্তরসহ তাদের বন্ধুরা অসহায় মানুষের মাঝে ইফতারি বিতরণ করেছেন।

এ ছাড়া ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও এসব স্বেচ্ছাসেবী করোনা রোগীদের রক্ত দিতে ভয় করেননি। করোনায় আক্রান্তদের বাড়িতে খাবার বা ওষুধ পৌঁছে দিতে পিছপা হননি। উল্টো পাল্লা দিয়ে কে কীভাবে সহযোগিতা করবেন, চলেছে তার প্রতিযোগিতা। এ তরুণ প্রজন্মই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাফনকার্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে সবুজ বাংলাদেশ, মেঘ ফাউন্ডেশন, নন্দন ফাউন্ডেশন ও ইনাফাসহ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিশাল ভূমিকা রেখেছে। জেলার বাইরে গিয়েও তারা লাশ দাফন করেছে।

আদর্শ সামাদিয়ান ২০১৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী ইফতে সামুল হক অবিনাশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুর্যোগকালীন দিনমজুর, অসহায় মানুষকে সহায়তা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। আমাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্যের মধ্যে সহায়তা করার চেষ্টা করছি। অসহায় মানুষগুলোর খবর পেলেই আমরা সহযোগিতা করে আসছি এবং পুরো রমজানেই অসহায় মানুষগুলোর মাঝে ইফতারি বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

মেঘ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ফাহাদ বিন বেলায়েত বলেন, লকডাউনে দিনমজুর ও শ্রমজীবীদের উপার্জন শূন্যের কোঠায়। সংসার খরচের টাকাও তারা উপার্জন করতে পারছেন না। পরিবারের জন্য সড়কে নেমে আসা মানুষগুলোকে একটু সহযোগিতা করতে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। যার যার সাধ্যমতো তাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি।

সবুজ বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বাবু বলেন, করোনার শুরু থেকেই লক্ষ্মীপুরে তরুণরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। এ জেলার তরুণ স্বেচ্ছাসেবীরা পাল্লা দিয়ে করোনায় আক্রান্তদের সহযোগিতা, করোনায় মৃতদের লাশ দাফন, কর্মহীনদের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণে কাজ করেছেন, যা অন্য জেলার চেয়ে অনেকাংশে বেশি মাইলফলক সৃষ্টি করেছে।

লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাইন উদ্দিন পাঠান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুগে যুগে তরুণরাই সব ক্রান্তিলগ্নে এগিয়ে এসেছে। কারণ, তরুণদের বুদ্ধি, শক্তি ও কর্মদক্ষতা বেশি। সব দুর্ভিক্ষ-দুর্যোগে তরুণরাই সবার আগে হাল ধরতে আসে। তেমনি করোনাকালীন এ মহামারিতে লক্ষ্মীপুরে তরুণদের গড়ে তোলা স্বেচ্ছাসবী সংগঠনগুলো নিরলসভাবে কাজ করছে। দেশে তারুণ্য ও যুবশক্তি রয়েছে। তাদের হাত ধরেই দেশ সঠিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।

হাসান মাহমুদ শাকিল/এনএ