দু-এক বেলা না খেয়ে থাকলেও পেটকে বোঝানো যায়, কিন্তু সপ্তাহে কিস্তিওলারা তো মানবেন না। যেভাবেই হোক তাদের টাকা জোগাড় করে দিতে হবে। করোনায় সরকার লকডাউন দেওয়ার পর থেকে বেচাকেনা নেই। পুলিশ একটু পরপর দৌড়ানি দেয়। তাই টুকটাক কাজ করে কিস্তির টাকা জোগাড় করি।

সোমবার (১৯ এপ্রিল) সকালে মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার দিঘীরপাড় বাজারের কামারপট্টি এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, হরকৃষ্ণ, হরপ্রসাদ, রাদাসাম, শিমান্ত ঘোষ, বাবুচন্দ্র, কৃষ্ণপালরা অবসর সময় পার করছেন। ঝিমানো দূর করতে একটু পর পর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন হরকৃষ্ণ। হরপ্রসাদ ও রাদাসাম উত্তপ্ত লোহায় হাতুড়ি আর হামারের বাড়ি দিচ্ছেন। গ্রেন্ডার মেশিনে আলতো পরশে লোহার মরিচা দূর করছেন বাবুচন্দ্র।

কামার হরকৃষ্ণ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর একটি বেসকারি সংস্থার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩ হাজার টাকা দিতে হয়। আগে কাজ করে টাকা পরিশোধ করতে তেমন কষ্ট না হলেও লকডাউনের কারণে এখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। লকডাউনের আগে প্রতিদিন আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা বেচাকেনা হতো। সেখানে একেকজনের দৈনিক মজুরি ৫০ থেকে ৬০০ টাকা থাকত।

একই বাজারের কামার হরপ্রসাদ (৪৮) বাবার হাত ধরে ১৭ বছর বয়সে এ পেশায় আসেন। কামারের কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ তার জানা নেই। তাই বলা যায় বাধ্য হয়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে এ পেশায় জীবনের বাকিটা সময় পার করে দিতে চান তিনি। তার মাথার ওপরেও রয়েছে ৯০ হাজার টাকার ঋণ। সেই ঋণের টাকাও ছয় সদস্যের সংসার চালাতে হয় কামারের কাজ করে।

হরকৃষ্ণ বলেন, কোনো দিন হাজার টাকাও রোজগার হতো। কিন্তু লকডাউনে বেচাকেনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উল্টো দোকানের খরচ ওঠানো যাচ্ছে না। এদিকে প্রতি সপ্তাহে ঋণের চাপে নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছি।

এদিকে পরে বিক্রির আশায় কৃষি সরঞ্জাম তৈরি করে মজুত করে রাখছেন শিমান্ত ও কৃষ্ণপালসহ অন্যরা। এ ছাড়া গৌতম, পিন্টু ও অমলের দোকানসহ আটটি দোকান বন্ধ রয়েছে।

হরপ্রসাদ বলেন, সরকার লকডাউন আমাদের ভালোর জন্যই দিয়েছে কিন্তু কিস্তি কেন খোলা রাখল? এখন রোজগার ছাড়া সংসার চালাব নাকি কিস্তি টাকা পরিশোধ করব? এমন প্রশ্ন সারারাত মাথায় ঘোরে। এতে ঘুমাতে পারি না। ছটফট করি পরের দিন কীভাবে চলব। দোকান খোলা রাখলেও দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা খরচ হয়। অথচ বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা মাত্র। সপ্তাহ শেষে কিস্তির স্যারেরা মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে টাকার জন্য। তাই ১০০ টাকার জিনিস ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছি। তাতেও কাস্টমার নেই।

তিনি আরও বলেন, গত বছর সরকার আড়াই হাজার টাকা মোবাইলে দেবে বলেছিল। সে সময় টাকার জন্য কাগজপত্র দিয়েছিলাম কিন্তু পরে টাকা আর পাই নাই। আর এ বছর তো সরকারি কোনো সহযোগিতার নামগন্ধও নেই। যদি সরকার সহযোগিতা করত, তাহলে কিছুটাও বাঁচতে পারব।

কামার রাদাসাম (৩২) কিছুদিন আগে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। বিয়ের পর ধারদেনা করে দোকানে মালামাল তুলেছিলেন। কিন্তু করোনার কারণে তেমন বিক্রি হয়নি। এখন লকডাউনে একেবারেই বেচাকেনা নেই। গতকাল ১৬০ টাকার কাজ করেছেন। আজ এখনো কাস্টমারের মুখ দেখেননি। এদিকে প্রতি সপ্তাহে তার মাথায় আড়াই হাজার টাকার ঋণের বোঝা। সব মিলে বিয়ের পর তার জীবনযাপন অনেকটাই কষ্টের হয়ে পড়েছে।

রাদাসাম বলেন, করোনার পর থেকে কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। ১ হাজার ৫০০ টাকার কয়লা বর্তমানে ৩ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে কাস্টমার পাওয়ার আশায় জিনিসপত্র অল্প দামে বিক্রি করে দিচ্ছি। তাতেও কাস্টমারের দেখা নেই। এভাবে চলতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে আমাদের। সরকার যদি লকডাউনের সময় কিস্তি বন্ধ করে দিত, তাহলে কিছুটা বেঁচে থাকা যেত।

একই অবস্থা এই বাজারের শিমান্ত, বাবুচন্দ্র ও কৃষ্ণপালসহ অন্যান্য কামারের। তাদের দাবি, সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি লকডাউনের সময় বিভিন্ন সংস্থা যেন কিস্তি আদায় বন্ধ রাখে।

ব.ম শামীম/এনএ