বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বগুড়া অফিসে দালাল ছাড়া যেন কোনো কাজই হয় না।দালাল না ধরলে পদে পদে ঝামেলা পোহাতে হয়। বিআরটিএ অফিসের ভেতরেই চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করেন এসব দালাল। সেবাপ্রার্থীদের সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষায়। আগে থেকে টাকা না দিলে পরীক্ষায় অকৃতকার্য করা হয়। তাই ঝামেলা এড়াতে বাড়তি টাকা দিয়ে নীরবে কাজ সারছেন অনেকে। 

তবে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ বলছে, অফিসে দালালের কোনো স্থান নেই। অফিসের বাইরে, ফটোকপির দোকানে কিছু মানুষ এসব অনিয়ম করার চেষ্টা করে।

বিআরটিএর নিয়ম অনুযায়ী, শুধু মোটরসাইকেল অথবা শুধু হালকা মোটরযানের লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স ফি ৫১৮ টাকা। মোটরসাইকেল ও হালকা মোটরযানের লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স ফি ৭৪৮ টাকা। স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ৫ বছর মেয়াদি পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স ফি ২ হাজার ৮৩২ টাকা। ১০ বছর মেয়াদি অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ব্যাংকে জমা দিতে হয় ৪ হাজার ৫৫৭ টাকা। ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষায় কেউ অকৃতকার্য হলে পুনরায় পরীক্ষার জন্য আরও ২৩০ টাকা দিয়ে আবেদন করতে পারেন। আর লার্নার কার্ডের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে তার নবায়ন ফি ২৮৮ টাকা। এ সকল প্রকার ফির সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাটযুক্ত করা আছে। অথচ এই ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে এসে একেকজনকে খরচ করতে হচ্ছে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দালালের সঙ্গে চুক্তির মধ্যে নির্ধারিত ফি ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি খাতে চলে যায়। বাকি ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা দালালদের হাত হয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট সবার পকেটে যায়। যার অন্তত ২ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হয় শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাস নিশ্চিত করার জন্য।

গত ২৯ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বগুড়া বিআরটিএ অফিসে ঘুরে ও বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। 

গত ২৯ জানুয়ারি বেলা ১১টার দিকে বিআরটিএ অফিসের বাইরে একাধিক পরীক্ষার্থীকে লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা যায়। লিখিত পরীক্ষার পর ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন তারা। এদের মধ্যে  দুজনের কাছে জানতে চাওয়া হয়- পরে যদি দেখেন ফেল করেছেন, কী করবেন? এমন প্রশ্নে তাদের একজন হাসেন। বলেন, ‘তবারক’ দিয়ে আসা হয়েছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বগুড়া সদরের গোদারপাড়া এলাকার এই বাসিন্দা জানান, এর আগে নিজেই আবেদন করেছিলেন। লিখিত, ভাইভা পরীক্ষাও হয়েছিল ভালো। তবু ফেল দেখানো হয়। এ জন্য এবার লোক ধরেছেন।

তার সামনে থাকা আরেক যুবক বলেন, ভাই এখানে সার্ভিস নিতে হলে আপনাকে টাকা খরচ করতেই হবে। না হলে ভোগান্তি থাকবে। আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ১২ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। নাম জানতে চাইলে বলেন, নাম শুনে কী করবেন? নাম-পরিচয় দিয়ে আবার হয়রানিতে পড়তে হবে।

একই লাইনে দিনাজপুরের হিলি সদর থেকে হালকা যানের অপেশাদার লাইসেন্স করাতে এসেছেন মুফাসসের রহমান। তিনিও ১২ হাজার টাকা দিয়েছেন ড্রাইভিং লাইসেন্স করার জন্য। মুফাসসের জানান, যেখান থেকে গাড়ি চালানো শিখেছেন সেখান থেকেই লাইসেন্স পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এভাবে করলে ঝামেলা করা লাগে না। একসঙ্গে অনেকগুলো ফাইল থাকায় বিআরটিএর লোকজন মোটা টাকা পায়।

এ লাইনের আশপাশে তিনজন ব্যক্তি ছিলেন। তারা নিজেদের লোককে লাইন ছাড়াই ভেতরে পাঠিয়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কাজ শেষে আবার পরীক্ষার রুমের দিকে নিয়ে যান। দুপুর ১২টার দিকে ওই তিনজনের মধ্যে একজনকে আবার দেখতে পেয়ে পরিচয় গোপন করে এই প্রতিবেদক কথা বলেন। লাইসেন্স করিয়ে দিতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে সঞ্জু পরিচয় দেওয়া ওই যুবক বলেন, ভাই আমি নিয়মিত আসি না। পরিচিত ও দলের লোকজনদের টুকটাক কাজ করে দিই। তবে তিনি বুদ্ধি দেন লার্নার কার্ড করার পর অফিসের কাউকে ২ হাজার থেকে ২৫০০ টাকা দিলে কাজ সহজে হয়ে যাবে। খরচও কম লাগবে। আর আলাদাভাবে করলে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা দিতে হবে।

পরদিন দুপুরে বিআরটিএ অফিসের সামনে ফারুক নামে এক ট্রাকচালককে অনেকক্ষণ বসে থাকতে দেখা যায়। এক সময় একজন ব্যক্তি তার কাছে এসে বলেন, টাকা লাগিয়ে দাও। কাজ হয়ে গেছে। এমন কথা শুনে ফারুকের কাছে আসার কারণ জানতে চাওয়া হয়। বগুড়ার শিবগঞ্জের মোকামতলা এলাকার এই বাসিন্দা বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স হারিয়ে গেছে। সেটা নেওয়ার জন্য এসেছি। এর আগে কয়েক মাস আগে এই ভাই আমার লাইসেন্স করে দিয়েছেন। কোনো ঝামেলা হয়নি। সেই লাইসেন্স হারানোর জন্য আবার তার কাছে আসা।

নিজে অফিসে গিয়ে করেননি কেন এমন প্রশ্নের জবাবে ফারুক বলেন, ভাই ওটাও দেখছি। ওরা টাকা খাবেই। মাঝখান থেকে শুধু দিনের পর দিন ঘুরাবে।    

তার কাছে থেকে রায়হান নামে ওই দালালের মোবাইল নম্বর নিয়ে কথা হয়। রায়হান মোটরসাইকেল ও হালকা যানের ক্ষেত্রে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স করে দেওয়ার জন্য ১১ হাজার টাকা চান। তিনি জানান, ১১ হাজার টাকা লাগবেই। আর পরীক্ষার দিন শুধু হাজির হতে হবে। বাকিটা তিনি দেখবেন। 

দালালদের এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) কথা বলতে গেলে অস্বীকার করেন বগুড়া বিআরটিএ অফিস কর্তৃপক্ষ। অথচ এই অফিসের নিচ তলার ভেতরে চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করেন দালালরা। সেদিনও নিচ তলায় গেলে মনু নামে এক ব্যক্তিকে কাগজপত্র নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। কিন্তু ক্যামেরার দিকে চোখ পড়তেই তড়িঘড়ি করে অফিস থেকে বের হয়ে যান মনু। যাওয়ার সময় কোন পদে কাজ করেন প্রশ্ন করলে তিনি শুধু বলেন, আমি কিছু জানি না।

এই মনু দীর্ঘদিন ধরে বগুড়া বিআরটিএ অফিসের ভেতরে বসে দালালির কাজ করেন। জেলার এই অফিসে সহকারী পরিচালক ছাড়া আরও ১০ জন নিয়োগপ্রাপ্ত জনবল রয়েছে। এর বাইরে আর কেউ অফিশিয়ালি এখানে কাজ করেন না।  

এদের নাম বলার পরও তাদের উপস্থিতির বিষয়টি অস্বীকার করেন সহকারী পরিচালক এটিএম ময়নুল হাসান। তিনি বলেন, এখানে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। আপনি কাদের কথা বলছেন তা জানি না। আমার অফিসে দালালের কোনো স্থান নেই।

তবে আলাপের একপর্যায়ে সহকারী পরিচালক বলেন, অফিসের বাইরে, ফটোকপির দোকানে কিছু মানুষ এসব অনিয়ম করার চেষ্টা করে। এ ছাড়া মোটর মালিক সমিতির লোকজন একটু চাপ দেয়। তবে আমরা কাউকে প্রশ্রয় দেই না। এ জন্য আমরা মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্ট দিয়ে তাদের ধরার চেষ্টা করি।

বিআরটিএর একটি সূত্র বলছে, বিআরটিএতে সবচেয়ে বেশি সংকট জনবলের। এই সংকটের সুযোগটাই নেন দালালরা।

এমন সংকটের কথা স্বীকার করলেও সহকারী পরিচালক ময়নুল হাসান অবশ্য দাবি করেন, বগুড়া অফিস চালানোর জন্য ১০ জন লোকবলই যথেষ্ট।

যানবাহন চালানোর সময় গাড়ির নিবন্ধন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স রাখা আইনের একটি অংশ বলে মন্তব্য করেন বগুড়া জেলা ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমন রঞ্জন সরকার। তিনি বলেন, গাড়ির নিবন্ধন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিজের নামে করে নেওয়া এবং সাথে রাখা এক রকম আইনগত বিষয়। আর এটা না রাখা মানে আপনি আইনকে সম্মান করছেন না। দেখা গেছে বেশিরভাগ অপরাধ সংঘটিত হয় অনিবন্ধিত যানবাহন দিয়ে। আবার যারা চালান তাদেরও ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকে না। নিবন্ধন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া ব্যক্তিকে বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িত মনে করা স্বাভাবিক।

আইন ভঙ্গকারীর ক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, বর্তমানে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ অনুযায়ী আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাস্তায় অবৈধ যান ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এ ক্ষেত্রে সাব ইন্সপেক্টর বা সার্জেন্ট থেকে তার ওপরের যে কোনো কর্মকর্তা এই আইন অনুযায়ী জরিমানা করে থাকেন। একই সঙ্গে প্রয়োজন বোধ করলে যানবাহন আটক করতে পারেন তিনি। এ ছাড়া বিআরটিএ বা জেলা প্রশাসন প্রয়োজনে অভিযান পরিচালনা করতে পারে।

আরএআর