বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চাঁপাইনবাবগঞ্জ অফিসে দালাল ছাড়া কোনো কাজ হয় না বলে অভিযোগ করেছেন সেবাপ্রার্থীরা। স্বাভাবিক নিয়মে কাজ করতে গেলে নানা ভোগান্তি ও দিনের পর দিন ঘুরতে হয়। দালালদের সঙ্গে অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এতে  দালালের মাধ্যমে গেলে সহজে পরীক্ষায় পাস করা যায়। 

তবে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ বলছে, জনবল সংকটের কারণে কাজে কিছুটা ধীরগতি আছে। অল্প জনবলে যতটা সম্ভব সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। 

সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিআরটিএ অফিসে সেবাপ্রার্থী, দালাল ও অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সেখানে সেবাপ্রার্থীরা নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করেন।   

শিবগঞ্জ বারোরশিয়া থেকে কার ও মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিআরটিএতে এসেছিলেন ফরিদ উদ্দিন। তিনি জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ যুব উন্নয়ন সেন্টার থেকে ড্রাইভিং শিখেছি। লিখতিতে পাস করেছি, পরবর্তীতে দেখা যাক কী হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের আজম আব্দুল্লাহ বলেন, আমার দুলাভাইয়ের পরিচিত মাধ্যম (দালাল) ধরে এসেছিলাম। লিখিত পরীক্ষা দিয়েছি, রেজাল্টের অপেক্ষা করছি। 

অফিস প্রাঙ্গণে মামুনের (দালাল হিসেবে পরিচিত) সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে দেখা যায় আজহারুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে। তিনি বলেন, আগে লাইসেন্স করা ছিল, রিনিউ করব। মামুনের সঙ্গে কী কথা বললেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার মাধ্যমে কাজটা করব। 

কত টাকা দিয়ে করলেন জানতে চাইলে আজহারুল বলেন, এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না, সে আমার বড় ভাইয়ের পরিচিত। টাকার বিষয়টি বড় ভাই জানেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দালাল জানান, প্রতি সোমবার পরীক্ষা হয়। অফিসে মোটরসাইকেল ও কারের ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য অতিরিক্ত দিতে হয় ৩৪০০ টাকা আর শুধু মোটরসাইকেল দিতে হয় ২৮০০ টাকা। এই টাকা অফিসে দিলে তিনটা পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেয়। আর সেদিনই রাত ৯টার দিকে রেজাল্ট হয়ে যায়।

তিনি বলেন, একেবারে লেখাপড়া না জানলেও টাকা দিলে তাদেরকে পাস করিয়ে দেয়। তবে অফিসে এক মাস থেকে কড়াকড়ির কারণে আমাদের মাধ্যমে কাজ একটু কমে গেছে। তবে বিআরটিএ অফিসের মামুনের কাজ বহাল আছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ডাইভিং ট্রেডের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, টাকা-পয়সার জন্য তারা আমাদের সঙ্গে ঝামেলা করে। আমাদের স্টুডেন্টদের তারা নীরবে ফেল করিয়ে দেয়। আমাদের ইন্টারমিডিয়েট বা অনার্স পাস করা ছাত্রদের ফেল করিয়ে দেয় অথচ যারা লেখাপড়া জানে না তাদেরকে তারা পাস করিয়ে দেয়।

তিনি আরও বলেন, ভাইভাতে ট্রাফিক সিম্বল ছাড়া অন্য কোনো কিছু ধরার নিয়ম নেই। কিন্ত তারা টিটিসির ছাত্রদের কঠিন প্রশ্ন করে আটকে দেয়। অন্যদের তারা আরেকজন ড্রাইভারের পাশে বসিয়ে পরীক্ষা নেয়। কিন্ত আমাদের ছাত্রদের ক্ষেত্রে খুঁটির সঙ্গে টাচ লাগলেই ফেল করিয়ে দেয়।

টিটিসির ছাত্রদের সঙ্গে এমন আচরণ করার কারণ কী জানতে চাইলে ওই শিক্ষক বলেন, আসলে তারা আমাদের কাছে কোনো সুবিধা পায় না। আমার কথা হলো আমি ছাত্রদেরকে পড়াবো, সে ভালো করলে পাস করবে আর ভালো না করলে ফেল করবে।

দালাল হিসেবে পরিচিত মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি বিআরটিএ অফিসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি হিসেবে আছি। শ্রমিক ইউনিয়নের যারা ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে আসে তাদেরকে সহোযোগিতা করি।

টাকা নিয়ে কাজ করার অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে তিনি বলেন, অফিসে এখন টাকা দিয়ে কাজ হয় না, আগে হতো। আসলে অনেকে আসে যারা লেখাপড়া জানে না বা কীভাবে কাজ করতে হবে তা কম বুঝে। তাদেরকে আমি সহোযোগিতা করি। তার বিনিময়ে মিষ্টি খাওয়ার জন্য যা দেয় তা রেখে দিই।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ট্রাক, ট্যাংকলরি ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামুন বিআরটিএ অফিসে আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে। আমাদের লোকজনের ড্রাইভিং লাইসেন্স করার সুবিধার্থে তাকে সেখানে দেওয়া হয়েছিল, যাতে ইউনিয়নের উপকার হয়।

টাকা নিয়ে মামুনের কাজ করার ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা ভালো দিক নয়। তার এই বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সভাতে আলোচনা করব।

আব্দুল খালেক বলেন, বিআরটিএতে স্টাফ কম। তাই কাজ কাম অনেক দেরি হয়, সুন্দরভাবে পেয়ে যাব তা সব সময় হয় না। বিআরটিতে যেন স্টাফ বাড়ানো হয় সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিআরটিএ অফিসের সহকারী পরিচালক মো. শাহাজামান হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিআরটিএ অফিসের স্টাফ কম। তাই শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি মামুন কাজ করছেন। 

তিনি বলেন, এখানে ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষার প্রক্রিয়া অন্য যে কয়টা জেলা আছে তার মধ্যে ভালো, ১০০ ভাগ ভালো সেটা বলব না। কারণ ১০০ ভাগ কোনো কিছু হয় না। এখানে প্রবলেম আছে, থাকবে। প্রবলেম নিয়ে মানুষের জীবন। প্রতিটা জিনিসের ঘাটতি আছে। আমার এখানে পাঁচজন অফিস স্টাফ। এর বাইরে আরও ছয়জন কাজ করে।

শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি কাজ করার বিষয়ে শাহাজামান হক বলেন, শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে এক বা দুইজন কাজ করে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে কাজ করতো শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা। তা কিন্ত এখন নেই। আমরা চেষ্টা করছি স্বল্প সংখ্যক জনবল নিয়ে যতটা পারি সেবা দেওয়ার জন্য। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পরিস্থিতি অন্য জেলার তুলনায় কিছুটা ভালো আছে। অন্য জেলায় কী হয়, না হয় সেটাতো আমি জানি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খাঁন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো ভুক্তভোগী সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে আমি ব্যবস্থা নেব। 

শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা মামুনের বিষয়ে তিনি বলেন, অফিসের লোক ছাড়া কেউ কাজ করতে পারবে না। এমন হয়ে থাকলে কঠিন অ্যাকশন নেব।

জেলা ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (প্রশাসন) আজিজ ফেরদৌস ঢাকা পোস্টকে বলেন, কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদনকৃত লার্নার কপি নিয়ে গাড়ি চালাতে পারবে না। তাছাড়া আমরা নিয়মিত সড়কে আইন প্রয়োগ করছি এবং আইন মেনে চলার ব্যাপারে সতর্ক করছি।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম সহিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রচলিত আইনের ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। ট্রাফিক আইন মেনে চলাতে সচেতেনতামূলক মিটিং, লিফলেট বিতরণ করা হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা সুজনের সভাপতি অ্যাডভোকেট নুরে আলম সিদ্দিকি আসাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত সেবা সহজতর করার লক্ষ্যে বিআরটিএ গত ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর বিআরটিএ সার্ভিস পোর্টাল বিএসপি চালু করেছে। এ প্রক্রিয়ায় লাইসেন্স প্রত্যাশীদের চারবার বিআরটিএ অফিসে আসার পরিবর্তে শুধুমাত্র একবার বিআরটিএ পরীক্ষা কেন্দ্রে এসে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও  বায়ো এনরোলমেন্ট প্রদান করা যাবে এবং মাত্র সাত দিনের মধ্যে ডাকযোগে ড্রাইভিং লাইসেন্স স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স প্রত্যাশীদের ঠিকানায় পৌঁছে যাবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো ১৫ মাস অতিবাহিত হলেও দেশের হাতেগোনা দুই এক স্থান বাদ দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের কোনো জেলায় এ কার্যক্রম শুরু হয়নি। এর অন্যতম কারণ বিআরটিএ অফিসগুলোতে দায়িত্বরত অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও জনবল সংকট। বিএসপি সেবা পূর্ণাঙ্গ রূপে চালু হলে লাইসেন্স প্রত্যাশীদের হয়রানি ও অসাধু লেনদেন বন্ধ হবে বলে আমি মনে করি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ও দায়েরা জজ আদালতের আইনজীবী নাজিব ফেরদৌস বলেন, বিআরটিএ একটি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। তবে এখানে অতিরিক্ত টাকা আদায় ছাড়া কোনো কাজ হয় না বা পাওয়া যায় না- এমন অভিযোগ দীর্ঘদিন সেবাগ্রহীতাদের কাছে শুনছি। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগী দুর্নীতি দমন কমিশনে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করতে পারেন।

আরএআর