লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের গেটের সিঁড়িতে পড়ে ছিলেন জোছনা বেগম নামের এক গৃহবধূ। প্লাস্টার করা ডান পা নিয়ে হাতকে বালিশ বানিয়ে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে তিনি শুয়ে আছেন। পাশেই ৪ বছরের শিশুটিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তার স্বামী রিপন। এটি দেখে মানুষ যে যার মতো সাহায্য করছিল। আর অসহায় রিপন অপলক দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৮টার দিকে সংবাদকর্মী রুবেল হোসেন অসহায় জোছনাকে পড়ে থাকতে দেখেন হাসপাতালের সিঁড়িতে। পরে বিস্তারিত জেনে বিশেষ অনুরোধে তিনি ওই গৃহবধূকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। তবে সমাজের বিত্তবান ও মানবিক মানুষগুলোর সহযোগিতা পেলে ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে নিলে উন্নত চিকিৎসায় জোছনা ফের নিজের পায়ের দাঁড়াতে পারবেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।

জোছনা বেগম সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের জামিরতলী গ্রামের বাসিন্দা। স্বামী মো. রিপন ও ছেলে মো. জুয়েলকে নিয়ে একই উপজেলার বটতলি এলাকায় সড়কের পাশে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করেন। তার স্বামী বিভিন্ন বাজার ও গ্রামে গ্রামে প্লাস্টিক বা ভাঙারি জিনিসপত্র খুঁজে এনে বিক্রি করে সংসার চালান। তাদের ভিটেমাটি নেই, আত্মীয়-স্বজনদেরও খোঁজ নেই। বর্তমানে জোছনা সদর হাসপাতালের চতুর্থ তলায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

হাসপাতালে জোছনার স্বামী রিপনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছয় দিন আগে সদর উপজেলার মান্দারী বাজারে রাস্তা পারের সময় একটি মোটরসাইকেলের সামনে পড়েন জোছনা। এতে জোছনা পায়ে গুরুতর আঘাত পান। মোটরসাইকেল চালক ছিলেন একই উপজেলার দিঘলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ মজিবুর রহমান। দুর্ঘটনায় শেখ মুজিব নিজেও আহত হন। পরে আহত অবস্থায় জোছনাকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডান পা ভেঙে যাওয়ায় প্লাস্টার করিয়ে ছয় দিন পর্যন্ত তাকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তবে তাকে ঢাকা কিংবা মাইজদি নিয়ে উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক।

কিন্তু টাকার অভাবে হাসপাতাল থেকে বের করে স্ত্রীকে কোথায় নেবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছিল রিপনের। অবশেষে মঙ্গলবার জোছনাকে হাসপাতাল থেকে ছাড় দেওয়া হয়। এ সময় চিকিৎসক জোছনাকে বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য অথবা ঢাকায় নিয়ে উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দেন। কিন্তু ছাড় পাওয়ার পরে হাসপাতালের গেটের সিঁড়িতেই কয়েক ঘণ্টা জোছনাকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। আর ছেলে জুয়েলকে কোলে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন রিপন। 

এমন দৃশ্য দেখে হাসপাতালে আসা অন্যান্য রোগীর স্বজনরা ১০, ২০ ও ৫০ টাকা করে কয়েকজন সহযোগিতা করেছেন। এরই মধ্যেই লক্ষ্মীপুর জেলায় কর্মরত সাংবাদিক রুবেল হোসেনের নজরে পড়েন তারা। পরে তিনি বিস্তারিত শুনে সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) আনোয়ার হোসেন ও চিকিৎসক নাজমুল হাসানের সঙ্গে কথা বলেন। হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ না থাকায় জোছনাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এজন্য চিকিৎসকরা ফের জোছনাকে ভর্তি নিতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু রুবেলের অনুরোধে ফের জোছনাকে হাসপাতালে ভর্তি রাখেন চিকিৎসক।

জোছনার স্বামী মো. রিপন জানান, তার কাছে টাকা-পয়সা নেই। জোছনাকে বাড়িতে নিয়ে তিনি কি করবেন। চিকিৎসা তো দূরের কথা ওষুধ কিনে খাওয়ানোর অবস্থা নেই তার।

সাংবাদিক রুবেল হোসেন বলেন, হাসপাতালের সিঁড়িতে পড়েছিলেন জোছনা। পরে চিকিৎসকদের অনুরোধ করে হাসপাতালে ফের ভর্তি করে দিয়েছি। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠাতে বলেছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু জোছনার অসহায় স্বামীর পক্ষে ঢাকায় নেওয়ার সামর্থ্য নেই। সমাজের বিত্তবানরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে জোছনাকে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করানো সম্ভব।

দিঘলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ মজিবুর রহমান বলেন, হঠাৎ জোছনা আমার মোটরসাইকেলের সামনে এসে পড়ে। এতে আমিও আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছি। জোছনার চিকিৎসার জন্য কিছু খরচ দিয়েছি। বাইরে চিকিৎসার ব্যবস্থা হলে সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।

লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) আনোয়ার হোসেন বলেন, জোছনার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। আমাদের হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। এজন্য তাকে আমরা ছাড়পত্র দিয়েছি। সর্বোচ্চ দুই দিন আমরা তাকে রাখতে পারব। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া জরুরি।

হাসান মাহমুদ শাকিল/এএম