দেশের উত্তর সীমান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গর্ভবতী মায়েদের নরমাল ডেলিভারিতে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছেন কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মেহেরুন নেহার লিলি। গত নয় বছরে করিয়েছেন হাজার প্রসূতির নরমাল ডেলিভারি।

মেহেরুন নেহার লিলি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের কাজিপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে সিএইচসিপি হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

সরেজমিনে ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, স্বাস্থ্যকর্মী লিলি বিভিন্ন রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন। গর্ভবতী মায়েদের পরামর্শ দিচ্ছেন, যাদের ওষুধ প্রয়োজন ওষুধ দিচ্ছেন।

চিকিৎসা নিতে আসা প্রসূতি শ্যামলি আক্তার, শারমিন আক্তার বৃষ্টিসহ কয়েকজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, লিলি আপা আমাদের নরমাল ডেলিভারি করিয়েছেন। কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি, খরচও হয়নি তেমন। মা-শিশু সবাই ভালো আছি।

জানা যায়, ১৯৯৮ সালে উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের কাজিপাড়া গ্রামে এই ক্লিনিকটি স্থাপিত হয়। জমি দিয়েছিলেন স্থানীয় নারী রমিনা খাতুন। ক্লিনিক থেকে তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরত্ব ২০ কিলোমিটার ও জেলা আধুনিক সদর হাসপাতাল ৩৫ কিলোমিটার। 

এলাকার গর্ভবতীদের প্রসবব্যথা উঠলেই স্বজনরা ছুটে আসেন মেহেরুন নেহার লিলির কাছে। নরমাল ডেলিভারি সেবার ফলে দরিদ্র প্রসূতি মায়েদের হাসপাতাল খরচ ও আর্থিক বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। চিকিৎসাসেবার জন্য কষ্ট করে যেতে হচ্ছে না শহরের হাসপাতালগুলোতে।

২০১১ সালে মেহেরুন নেহার লিলি কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডর (সিএইচসিপি) হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। যোগদানের পর তেঁতুলিয়া হাসপাতাল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন প্রাথমিক চিকিৎসা।

২০১৪ সালে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে কমিউনিটি স্কিল বার্থ অ্যাটেন্ডেন্ট (সিএসবিএ) বিষয়ে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৫ সালে স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি শুরু করেন নরমাল ডেলিভারির কার্যক্রম। বুকে দুরু দুরু ভয় নিয়ে প্রথম ডেলিভারির কাজ করেছিলেন। মাত্র এক ঘণ্টার চেষ্টায় সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসবের পর থেকেই ভয় ভাঙে তার। ধীরে ধীরে প্রসূতি মায়েদের সাহায্য করতে পেরে আনন্দ পেতে শুরু করেন।

সন্তানদের সঙ্গে মেহেরুন নেহার লিলি 

এভাবেই গত ৯ বছরে এক হাজার প্রসূতির নরমাল ডেলিভারি করিয়েছেন তিনি। বর্তমানে সীমান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাইলফলকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে হয়ে উঠেছেন আস্থার প্রতীক। এ কারণে ক্লিনিকটি উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ক্লিনিক হিসেবে পুরস্কার লাভ করেছে।

সিএইচসিপি মেহেরুন নেহার লিলি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ নরমাল ডেলিভারিতে এক হাজার সম্পন্ন করতে পারলাম। বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) হাসিনা বেগমের নরমাল ডেলিভারি করিয়ে ১০০০ সম্পন্ন করেছি। এর আগে রুপসানা নামের আরেক প্রসূতির নরমাল ডেলিভারি করিয়ে ৯৯৯ সম্পন্ন হয়। এ জন্য আমাকে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

লিলি আরও বলেন, এ ক্লিনিকে যোগদানের পর এখানকার হতদরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত যারা সিজার করাতে পারেন না তাদেরকে সেবা দিতেই এ কাজ শুরু করি। হাসপাতালের বাইরেও অনেকে আমার কাছে নরমাল ডেলিভারি করাতে আস্থা রাখছেন। এখন পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিটি মা ও শিশু সুস্থ রয়েছে। এখন রাত-দিনে সমস্যা হলেই ডাক পড়ে। রোগীরা সরাসরি কিংবা মুঠোফোনে সমস্যার কথা বলছেন। তাদের সেবা করতে পেরে ভালো লাগে।

প্রথম ডেলিভারির অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে লিলি বলেন, প্রথম প্রথম আমার খুবই ভয় লাগত। ভাবতাম এ জটিল কাজ কীভাবে সম্ভব! ফরিদা আক্তার নামের এক নারীর প্রথম ডেলিভারি সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে আমার সাহস বেড়ে যায়। কনকনে শীতে অথবা বৃষ্টিতে ভিজে, সারারাত পরিশ্রম করে যখন একটি গর্ভবতী মায়ের গর্ভ থেকে ফুটফুটে সুস্থ সন্তান দুনিয়াতে আসত তখন ভুলে যেতাম সব কষ্ট। ডেলিভারি করতে পারলে আমার খুব আনন্দ হয়। আমার কাছের আত্মীয় অনেকের ডেলিভারি করেছি, যেটা আমার ভালো লাগা ও প্রাপ্তি। আমার এ অসাধ্য কাজে সার্বিক পরামর্শসহ সাহস জুগিয়েছেন তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. পীতাম্বর রায়, এইচ আই শরীফ উদ্দিন, এএইচআই জমির উদ্দিন, এইচএ দেলোয়ার হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই।’

নরমাল ডেলিভারির কাজে সন্তুষ্ট গৃহবধূ হাসিনা বেগম ও রূপসানা বলেন, ‘লিলি আপা ভালো মানুষ। যখনই তাকে ফোন দিয়েছি তখনই পেয়েছি। নরমাল ডেলিভারিতে তাকে ডাকলেই পাওয়া যায়। খুব সুন্দরভাবে অল্প সময়েই আমাদের ডেলিভারি সম্পন্ন করেছেন। তার কাজে আমরা সবাই সন্তুষ্ট।’

স্থানীয় শেখ কামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাস্থ্যকর্মী লিলির মাধ্যমে সঠিক সেবা পাচ্ছে এ এলাকার মানুষ। আমাদের বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-পুরুষ আসছে চিকিৎসাসেবা নিতে। ভালোভাবে নরমাল ডেলিভারি হচ্ছে। তার এ পর্যন্ত নরমাল ডেলিভারিতে কোনো খারাপ রিপোর্ট আসেনি। সে আমাদের এলাকার আইকন।

স্থানীয়দের দাবি ক্লিনিকটি আরও উন্নতমানের করা হলে সুবিধা পাবেন হাজার হাজার মানুষ। ক্লিনিকটি স্থাপিতের পর থেকে কোনো ধরনের সংস্কার করা হয়নি।

জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোস্তফা জামান চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশের সর্ব উত্তরের একটি সীমান্ত অঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিকে এক হাজার নরমাল ডেলিভারি করা অত্যন্ত গৌরবের ও স্বাস্থ্য সেবার জন্য খুবই প্রশংসনীয়। উত্তরাঞ্চলে এমন ঘটনা খুবই কম। সাধারণত সরকার শিশু মৃত্যুর হার কমানো ও নিরাপদ মাতৃত্বসহ স্বাস্থ্য সেবার অগ্রগতিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। নিরাপদ মাতৃত্বে সিএইচসিপি মেহেরুন নেহার লিলির এমন রেকর্ড প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। তাকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

এনটি/এমজেইউ