বরগুনার তালতলী উপজেলার তালতলী পাড়ার বাসিন্দা মং তাহান রাখাইন ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে প্রায়ই লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। নিজেদের ভাষা টিকিয়ে রাখতে তিনি একজন সক্রিয় আন্দোলনকর্মীও বটে। লেখালেখি ও আন্দোলন এগিয়ে নিতে সব কিছুই করতে হয় বাংলায়। জন্মসূত্রে তিনি বাংলাদেশি হলেও তার মাতৃভাষা রাখাইন। 

বার্মার আরাকান রাজ্য থেকে পূর্ব পুরুষ বিতাড়িত হওয়ার পর সব হারিয়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় এই জনপদে বসতি গড়েন মং তাহান। চার পুরুষের এই বসতির ইতিহাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে জীবনযাপনে। অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন একা কিংবা সমবেতভাবে। সব কিছুতে ছাড় দিলেও মাতৃভাষা চর্চায় দৃঢ় থেকেছেন।

মং তাহান বলেন, আমরা পরিবারের সবাই রাখাইন ভাষায় কথা বলি। আমার ছেলের ঘরের নাতনি, ওর বয়স খুবই কম। আমিই প্রতিদিন সেই শিশুর সাথে রাখাইন ভাষায় কথা বলি। আমার পরের প্রজন্ম তার পরের প্রজন্মকে আমার মায়ের ভাষা শিখিয়ে যাবে। আমাকে যেমন আমার পিতা, পিতামহ শিখিয়েছেন। এভাবেই আমাদের মায়ের ভাষা টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে।

শুধু মং তাহান নয়, বরগুনার তালতলী, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, রাঙ্গাবালী উপজেলায় বর্তমানে বসবাস করা প্রায় ৪২০০ রাখাইন মায়ের ভাষা টিকিয়ে রাখতে একই উপায়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। রাখাইনরা নিজেদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নয় বরং জাতি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ২৪০ বছরেও এসব অঞ্চলে রাখাইন ভাষা চর্চার কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় মায়ের মুখ থেকে শিখে ভাষা বলতে পারলেও অধিকাংশই মাতৃভাষার বর্ণমালা চেনেন না।

কলাপাড়ায় রাখাইন জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা মংলা সিন বলেন, ১৭৮৪ সালে বার্মার আরাকান রাজ্যে মুঘল শাসকের সঙ্গে যুদ্ধে করুণ পরাজয়ের পর আরাকান অঞ্চলের বাসিন্দারা পরাজিত হয়ে ৫০টি নৌকা নিয়ে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ভাসতে শুরু করেন বঙ্গোপসাগরে। ১১ দিন ভেসে থাকার পর পশ্চিমে দেখতে পান বন। আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রথমে রাঙ্গাবালী উপজেলায় ওঠেন। সেখান থেকে খেপুপাড়া, তালতলীতে বসতি স্থাপন করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন উপজেলার শতাধিক পাড়ার মধ্যে ভাষা শিক্ষার জন্য মাত্র ৮-১০টি স্ক্রিপ্ট রয়েছে। মূলত আরাকান থেকে চোরাই পথে রাখাইন ভাষার কিছু বই আসে কক্সবাজারে। সেখান থেকে ভিক্ষুরা রঙিণ ফটোকপি করে স্ক্রিপ্ট নিয়ে আসেন পটুয়াখালী-বরগুনায়।

তালতলীর ছাতন পাড়ার অংমিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে রাখাইন ভাষা শেখান। তিনি বলেন, আমাদের মাতৃভাষার প্রেম অন্যদের তুলনায় আলাদা। আমাদের জাতির অনেকেই বাংলা ভাষায় পড়ালেখা করে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আমরা কখনো মাতৃভাষাকে এড়িয়ে যাই না। আমাদের সকলে হয়তো রাখাইন বর্ণমালা চেনে না, কিন্তু এই ভাষা শেখার একটা তাগিদ থাকে।

তিনি বলেন, শিশুর জন্মের প্রথম ৮ বছর আমরা রাখাইন ভাষা শিক্ষায় জোর দেই। এরপর থেকে বাংলা, ইংরেজি ভাষা শেখে।

উন্নয়নকর্মী চংনায় চিং বলেন, ২০১৫ সালে রাখাইন ভাষা শিক্ষার জন্য দুই বছরের একটি প্রকল্প চালু হয়েছিল। তখন আমাদের সম্প্রদায়ের শিশুরা ভাষা চিনতে পারার সুযোগ পায়। সেই স্কুলটি এখন বন্ধ। ফলে রাখাইন ভাষা শেখার সুযোগও বন্ধ। এই স্কুলটি পাইলট প্রকল্প আকারে নয় স্থায়ীভাবে চালু করার দাবি জানাই।

সরেজমিনে বরগুনার তালতলী ও ছাতনপাড়া, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আমখোলাপাড়া, মিশ্রিপাড়া ও কুয়াকাটার রাখাইনপাড়া ঘুরে দেখা গেছে, অধিবাসীরা নিজেদের মধ্যে সকল কথাবার্তা রাখাইন ভাষায় বলছেন। এসব পাড়া সংলগ্ন বিদ্যালয়গুলোতে শিশুরা লেখাপড়া করলেও সেসব বিদ্যালয়ে রাখাইন ভাষা চর্চার সুযোগ নেই।

আমখোলা পাড়ার তাঁতি মেনুং বলেন, আমি রাখাইন বর্ণমালা চিনি। কিন্তু আমার সন্তানরা চেনে না। তারা পড়ার সুযোগ পায়নি। সরকার এগিয়ে না আসলে আসলে আমাদের ভাষা টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। আমাদের ভাষা শিক্ষার জন্য স্কুল চালুর পাশাপাশি শিক্ষক রাখতে হবে। শিক্ষকের সম্মানিরও ব্যবস্থা করতে হবে।

মিশ্রিপাড়ার লোকাসুক বৌদ্ধ বিহারে অবস্থিত রাখাইন ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রটি চালু হয়েছিল ২০১৫ সালে। সেটিও বন্ধ। এই বৌদ্ধ বিহারের প্রধান উত্তম ভিক্ষু বলেন, রাখাইন ভাষা টিকিয়ে রাখতে এখন ধর্ম প্রতিষ্ঠানগুলোই গুরুত্ব বহন করছে। ভিক্ষুরা উপাসনালয়ে শিশুদের রাখাইন ভাষা শেখায়। এছাড়া ভিন্ন কোনো উপায় নেই। এখানে রাখাইনদের নামে সরকারি বিদ্যালয় আছে কিন্তু রাখাইনদের ভাষা শিক্ষার কোনো বিদ্যালয় নেই। তিন-চারটি পাড়া মিলিয়ে যদি অন্তত একটি করে হলেও আমাদের ভাষা চর্চার কেন্দ্র করে দেওয়া হয় তাহলে হয়তো ভাষা টিকবে।

কুয়াকাটার শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহারের উপাধ্যক্ষ ইন্দ্রবংশ ভিক্ষু বলেন, আমাদের মাতৃভাষা হচ্ছে রাখাইন ভাষা। এর পাশাপাশি যেহেতু আমরা বাংলাদেশে আছি তাই বাংলা ভাষা, ইংরেজি ভাষা আবার অনেকে হিন্দি ভাষাও জানেন। শিক্ষিতের হার বাড়লেও রাখাইন ভাষা অনেকেই চেনেন না। বৌদ্ধ বিহারে কিছু শিশুদের শেখানো হয়, তাও নানান প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে। আমি মনে করি সরকার অন্যান্য উপজাতির ভাষা পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করেছে। আমাদের ভাষাও পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করে আমাদের শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগ তরে দেবে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক ইলিয়াস হোসাইন বলেন, সরকার যে ৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো রাখাইন। এই অঞ্চলে এক সময় রাখাইন জনগোষ্ঠীর ৫০ হাজারের মতো মানুষ ছিল। এখন তা কমে ৪-৫ হাজারে এসেছে। তাদের মুখের ভাষা তাদের মুখেই রয়ে গেছে। কোনো পাঠ্যপুস্তকে সংরক্ষিত হয়নি। সরকার ২০১৭ সালে পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা প্রাক-প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে। তাতে রাখাইন ভাষা নেই। যদি এই ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা সরকার না করে দেয় তাহলে বাংলাদেশে বৈচিত্রের মাঝে যে ঐক্য তা অটুট রাখা সম্ভব না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক মোহাসম্মদ হাবিবুল্লাহ বলেন, বাঙালি জাতির ইতিহাস কিন্তু মাতৃভাষা রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দেওয়ার ইতিহাস। কিন্তু সেই অনুপ্রেরণা আমরা ধারণ করছি না। জীবনদানের ইতিহাস আমরা পড়াচ্ছি। অথচ রাখাইনদের মাতৃভাষা টিকিয়ে রাখতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। এভাবে কোনো গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে আমাদের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগের উপ-পরিচালক মিজ নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, অনগ্রসর জাতিদের শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে আমাদের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। তবে রাখাইন বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা চর্চার জন্য বরিশাল বিভাগে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। চট্টগ্রাম বিভাগে কয়েকটি রয়েছে।

আরএআর